বারিধারা থেকে বেইলি রোড: যা হলো ড. কামালের বাসায়

মঙ্গলবার (২৮ আগস্ট) রাত পৌনে দশটায় খানিকটা হট্টগোলের মধ্য দিয়েই ভাঙলো ছয় জ্যেষ্ঠ নেতার পৌনে দুই ঘণ্টার বৈঠক। রাজধানীর বেইলি রোডে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বাসার নিচতলার ড্রইংরুমে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।

পুরো বৈঠকে দেশের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের বিষয়ে আলোচনা হয়। বরাবরের মতোই এবারও আলোচনা শেষে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল।

এ সময় পাশে ছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। তবে বৈঠকে থাকলেও সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণার সময় ছিলেন না নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না।

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর তিন দলীয় যুক্তফ্রন্টের দুই নেতা জানালেন, ড. কামাল ও বি চৌধুরী যৌথভাবে কাজ করার বিষয়ে একমত হওয়ার পর একটি সাব-কমিটি গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়। সাংবাদিকদের সামনে এসে এই সাব-কমিটির বিষয়ে কথাও বলেন বি চৌধুরী।

কমিটিতে যাদের নাম উচ্চারিত হয়েছে, তারা হলেন- মোস্তফা মহসীন মন্টু, মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, আবদুল মালেক রতন ও জাহিদুর রহমান। শেষ নামটি যুক্ত হওয়ার পর ড. কামাল প্রশ্ন তোলেন ‘কে এই জাহিদ?’ সে সময় জাহিদকে নাগরিক ঐক্যের নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন মাহমুদুর রহমান মান্না। আর তখনই ড. কামাল বলে ওঠেন, ‘এমন নেতার নাম দিলে তো আরও ১০ জনের নাম যোগ করতে হবে। তখন শুরু হয় হট্টগোল।

নেতারা উঠে বসেন। সিনিয়র নেতারা চলে আসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে। একদিকে ড. কামাল হোসেনকে পাশে রেখে বি চৌধুরী বলছিলেন, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে তারা দুজন একমত হয়েছেন। অন্যদিকে পাশ থেকে আরেকজন নেতা বললেন, ‘কিছুই হবে না।’ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথার বলার এক ফাঁকেই গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে বেরিয়ে যান মাহমুদুর রহমান মান্না। ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

যুক্তফ্রন্টের এক নেতা হতাশ কণ্ঠেই বললেন, ‘কিছুই হচ্ছে না।’ বি চৌধুরী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করার পরই সুলতান মোহাম্মদ মুনসুর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘২২ সেপ্টেম্বর সমাবেশে সবাই থাকবেন।’ সঙ্গে-সঙ্গেই বিরোধিতা করেন বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী। তিনি বললেন, ‘এসব বিষয়ে কোনও আলাপই হয়নি।’

মঙ্গলবার ড. কামাল হোসেনের বাসার বৈঠক নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা ছিল ব্যাপক। বিকাল থেকে বেইলি রোডের ছায়া সুনিবিড় বাসভবনে আসতে থাকেন গণমাধ্যমকর্মীরা। কথা ছিল সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হবে বৈঠক। সময় ঘনিয়ে এলেও বৈঠকের সম্ভাব্য ব্যক্তিরা এসে তখনো পৌঁছাননি বৈঠক স্থলে। খবর পাওয়া গেলো বারিধারার কূটনৈতিক জোনে সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর বাসায় বৈঠকে বসেছেন তিন দলীয় যুক্তফ্রন্ট।

উদ্দেশ্যে, ড. কামাল হোসেনকে দেওয়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করা। বিকাল ৫টা থেকে শুরু হওয়া ওই বৈঠক শেষ হতে প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা বাজে। এরপরই যুক্তফ্রন্টভুক্ত বিকল্প ধারা, নাগরিক ঐক্য ও জেএসডি নেতারা আসেন ড. কামালের বাসায়। ঘড়িতে তখন রাত ৮টা। এরপর সৌজন্য কথাবার্তা শেষে প্রথমেই বক্তব্য দেন ড. কামাল হোসেন। পরিস্থিতির ওপর বক্তব্য দেওয়ার পর বি চৌধুরীও আলোচনা করেন।

ড. কামালকে জেএসডি’র আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘আপনি আর দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।’ তার বক্তব্যে বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনকে একসঙ্গে চলার জন্য জোরালো আহ্বান ছিল। একপর্যায়ে ড. কামালকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনি আর দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। এখন থেকে নির্বাচন পর্যন্ত দেশের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।’

বি চৌধুরী ও ড. কামালের উদ্দেশে আ স ম রব আরও বলেন, ‘আমরা জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠন করতে চাই। আপনারা দুজন সামনে এগিয়ে যান। আমরা সঙ্গে থাকব। আপনারা মিনিমাম কর্মসূচি দিলে শেখ হাসিনার সরকার পালাবার জায়গা পাবে না।’

সরকারের সমালোচনা করে রব বৈঠকে বলেন, ‘দলীয় সরকার জাতি, সংবিধান শেষ করে দিয়েছে, এমনকি বঙ্গবন্ধুকে শেষ করেছে এই দলীয় সরকার।’

বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনকে উদ্দেশ করে আসম রব বলেন, ‘আপনারা সজ্জন ব্যক্তি। আপনারা দুজন ঠিক করুন মাঠে নামবেন কিনা, আপনারা একসঙ্গে দাঁড়ালে আমরা যাবো। আমরা বলছি, জাতির প্রয়োজনে আপনাদের দুজনকে লাগবে। আপনারা দুজন আগাবেন কিনা বলেন। আন্দোলন করে স্বৈরাচার হটাতে হবে। ঐক্যের জন্য এটাই প্রথম শর্ত।’

আলোচনার একপর্যায়ে রব বলেন, ‘কোয়ালিশন সরকার বিএনপি গ্রহণ করবে কিনা?’ এ কথার জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে মেজর (অব.) মান্নান বলেন, ‘এক স্বৈরাচারকে বাদ দিয়ে আরেক স্বৈরাচারকে আনবো কিনা?’

বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান আলোচনার শেষ দিকে এসে বিএনপির ১০ দফা প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রস্তাবনায় থাকা ‘রাষ্ট্র ক্ষমতার গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য’ প্রসঙ্গে মান্নান বলেন, ‘বিএনপি ভারসাম্যের পক্ষে না, এটা আবেগ দিয়ে করেছে। আজকে আমরা যে সংগ্রাম করছি, বিএনপির সময় একশগুণ বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমরা এক স্বৈরাচারকে বাদ দিয়ে আরেক স্বৈরাচারকে আনবো কিনা?’

আবদুল মান্নানের বক্তব্যের জবাবে আ স ম রব বলেন, ‘কোয়ালিশন সরকার বিএনপি গ্রহণ করবে কিনা?’

এ সময় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘নেতৃত্ব এক হবে না, যৌথ নেতৃত্ব হবে। বিএনপির অনেক দাবির সঙ্গে অন্যদের দাবির মধ্যে মিল আছে।’

জাফরুল্লাহ চৌধুরী আরও বলেন, ‘সরকার গঠন করতে পারলে মন্ত্রণালয় ৫/৫ ভাগ হবে প্রয়োজনে। রাষ্ট্রপতির পদটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। মোটকথা আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে, কৃষক শ্রমিকের পক্ষে। তাদের স্বার্থটা কিন্তু দেখতে হবে।’

বৈঠকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমরা ক্ষমতার ভারসাম্য চাই। সংসদে কেউ মেজরিটি অর্জন করলেই ভারসাম্য হয়ে যায় না।’ এ সময় তিনি মালয়েশিয়াসহ দুয়েকটি রাষ্ট্রের কথা উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা দেন। শেষদিকে তিনি বলেন, ‘আমরা ভারসাম্য নিষ্পত্তি করার বিষয়ে চিন্তা করব নাকি ঐক্য দরকার?’

একপর্যায়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এদেশে আইনের শাসন দেখতে চাই। বড় দল কেউ আসতে চাইলে ওয়েলকাম। আগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।’

পৌনে দুই ঘণ্টার বৈঠকে কয়েক দফায় বিএনপির ১০ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন অনেকে। বৈঠক শুরুর আগে যে দুয়েকজন নেতা ১০ দফা প্রস্তাবের বিষয় অস্বীকার করেছেন, তারাই বৈঠকে ১০ প্রস্তাবের ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলেছেন।

বৈঠকের পরে এ প্রসঙ্গে বি চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপির প্রস্তাব সম্পর্কে কোনও আলোচনাই হয়নি।’

বৈঠকে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে সাত দফা ও গণফোরামের পক্ষ থেকে সাত দফা উপস্থাপিত হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

উৎসঃ   banglatribune

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin