bnp-flag

নির্বাচনে আবার আগ্রহ হারাচ্ছে বিএনপি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০-দলীয় জোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বড় শরিক বিএনপি ছাড়া অন্য কোনো দল নির্বাচনের মাঠে নেই। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনের পর বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না- এমন ঘোষণা বিএনপিও দিয়েছিল।

কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা পরিবর্তন করা হয়, যা নিয়ে দলের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। এ নিয়ে তৃণমূল ও দলের বিভিন্ন অংশের চাপ থাকলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুই-তিন জন নেতার মতামতের ভিত্তিতে এখানো নির্বাচনের মাঠে রয়েছে বিএনপি।

সাম্প্রতিক ঘটনায় এখন তারেক রহমানও নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এই অবস্থায় দলটির ভেতরে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। তৃণমূলের নেতারাও বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটে না যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, ভোটে অংশ নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন বা স্থানীয় সরকারের ভোটের প্রতিটিতে দলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হচ্ছেন। অধিকাংশেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হচ্ছে। মামলা-হামলার শিকার হচ্ছেন নেতাকর্মী। সব নির্বাচনেই কারচুপির অভিযোগ এনে মাঝপথে ভোট বর্জন বা ফল প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। এতে বিএনপি ধীরে ধীরে হাসির পাত্রে পরিণত হচ্ছে।

যদিও নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষের নেতাদের যুক্তি হচ্ছে- নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি কী করবে? প্রচলিত যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, গুম-খুন, ক্রসফায়ার এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। বিদ্যমান অবস্থায় যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে এর বিরুদ্ধে রাজপথে গণআন্দোলন তৈরির মতো সক্ষমতাও দলটি হারিয়েছে।

ফলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এখানে জয়লাভ বিষয় নয়। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা দুটি লাভও খুঁজে পেয়েছেন- একটি হচ্ছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ফলে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করে ভোটাধিকারের দাবি জোরালো করা, দ্বিতীয়ত, জনগণ বারবার ভোট দিতে পারছে না এটা তাদের মনে করিয়ে দেওয়া এবং তাদের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটানো ।

অন্যদিকে, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মাঠের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। নতুন নতুন মামলার কারণে নির্বাচনী এলাকার অনেক নেতাকর্মীকেই পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে। অনেক নেতাকর্মীই আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত। কিন্তু যারা সিদ্ধান্ত দেন, যারা দল পরিচালনা করেন, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। আবার বিএনপির ভোট বর্জনের ঘটনা এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ভোট চাইতে গেলে ভোটাররাও বলছেন বিএনপি তো ভোটে থাকবে না। ভোট কারচুপি করে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে জয়ী করা হবে সে বিষয়ে জনগণও জানে। তাই বিএনপির নির্বাচনে যাওয়াকে তারা ‘হাস্যকর’ বলছেন।

এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যদিও আমরা দেখছি, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল তা থেকে এসব উপনির্বাচনের কোনো পার্থক্য নেই। একইভাবে একই কায়দায় ভোট ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পার্থক্যটা হচ্ছে ওই সময়ে ভোটের আগের রাতে ২৯ ডিসেম্বর ডাকাতি করা হয়েছিল, এখন এসব নির্বাচনে ভোট হয়, ভোটার যায় না, ঘোষণা হয় মাত্র।

এর পরও অনেকে প্রশ্ন করেন, তা হলে আপনারা কেন যাচ্ছেন নির্বাচনে? আমরা আগেও বলেছি। আমরা একটা লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পথ- নির্বাচনের মধ্য দিয়েই হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রের ন্যূনতম স্পেসটুকু আমাদের ব্যবহার করা প্রয়োজন। আমরা জানি, এ নিয়ে অনেকের অনেক রকম কথাবার্তা আছে। কোনো সুযোগ আমরা দিতে চাই না এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে।

যদিও বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসন্ন ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনে যদি ভোট কারচুপি, জালিয়াতি ও এজেন্ট বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটে, তবে এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। বরং আগাম নির্বাচনের দাবিতে দলটি আন্দোলনে নামার চিন্তা করছে। আর ওই দাবির সঙ্গে যুক্ত হবে নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা ও নির্বাচন কমিশন বাতিলের দাবি। তবে আপাতত স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচন বর্জন করবে না দলটি।

জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, প্রথমত হচ্ছে- নির্বাচন অংশ নেওয়া হচ্ছে একটা সিস্টেমের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকা- তা প্রমাণ করা। অর্থাৎ যা খুশি হোক আমরা এটায় অংশগ্রহণ করব। দ্বিতীয়ত হচ্ছে- যেভাবে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তাতে করে নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা হতাশা এসেছে। তারা মনে করছে আমরা বারবার কেন এই যন্ত্রণার মুখোমুখি হচ্ছি। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ও আছে, আবার আমি সম্মান জানিয়েই গেলাম তা-ও আছে। এই জানাতে জানাতে তো আমাদের অবস্থা খারাপ। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দলে আলোচনা হচ্ছে। এখন তা আরও জোরালো হচ্ছে। শিগগিরই একটা সিদ্ধান্তে আসার সম্ভাবনা আছে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি ঘোষণা দিয়েছিল, এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু এর পর গত দুই বছরে সংসদের দুটি ছাড়া সবগুলো উপনির্বাচনে অংশ নিয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থীরা। ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় ঢাকা-১৮ এবং সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনেও প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। সবশেষ গত ১৭ অক্টোবর নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটের দিন ‘কারচুপির’ অভিযোগ এনে দুপুরে বর্জনের ঘোষণা দেন ধানের শীষের প্রার্থী। একই দিন ঢাকা-৫ উপনির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করেন এ আসনের বিএনপির প্রার্থী।

পরে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে সারাদেশে বিএনপির দুই দিনের বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। দৃশ্যত ফল কী হবে জেনেও সব নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। এত কিছুর পরও দলটি কেন বারবার নির্বাচনে যায়- এ প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। এমনকি এ নিয়ে গুটিকয়েক নেতা ছাড়া বিএনপির কেন্দ্রের বেশিরভাগই বিরক্ত। তারা বলেন, নির্র্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে বিভক্তি বাড়ছে। ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহাসচিবের বাসায় ডিম নিক্ষেপ, ১৭ নেতাকে বহিষ্কার, গতকাল শুক্রবারও প্রচার শুরুর দিন ধানের শীষের প্রার্থী এস এম জাহাঙ্গীরকে কালো পতাকা প্রদর্শন ও ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিএনপির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতারাও দুভাগে বিভক্ত। ঢাকা-৫ আসনের নেতাকর্মীরাও বিভক্ত। এ আসনের উপনির্বাচনে নবীউল্লাহ নবী মনোনয়ন না পাওয়ায় তার লোকজন ভোটের মাঠে ছিলেন না। নওগাঁ-৬ ও পাবনা-৪ উভয় আসনেই বিভক্তি দেখা দিয়েছে। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তিনি পাবনা-৪ আসনের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিবও ছিলেন। তিনি বলেন, শুধু শুধু অর্থ ও নিজের শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ ফল যেখানে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, সেখানে এসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পক্ষে আমি নই। এতে কর্মীরা উজ্জীবিত হওয়া তো দূরের কথা তারা আরও হতাশ হচ্ছে। আসলে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, আমরা যারা জেলে যাওয়ার ভয়ে বা মামলার ভয়ে সরকারকে খুশি করার জন্য যে একটা নির্বাচনের খেলা খেলছি- এটি সাময়িক। এতে দলই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন সরাসরি আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের দায়িত্ব পালন করছে- এটি তো প্রমাণিত। নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে পাবনা-৪ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপির প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৩টি মামলা হয়েছে। যেখানে আসামি বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।

উৎসঃ   আমাদের সময়

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin