didarul

নিজ দল আওয়ামী লীগের ৮ নেতাকর্মীর খুনি দিদারুল!

এ মুহূর্তে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ একজন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। তিনি লালখানবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম। দল ক্ষমতায় থাকলে চট্টগ্রাম শহরে নিজের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো দাপিয়ে বেড়ান আর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলে তিনি পালিয়ে যান বিদেশে। নিজ দলের মোট আটটি হত্যার ব্যাপারে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

সব হত্যাকা-ের শিকার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ অথবা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। এ তালিকার সর্বশেষ ঘটনা গত ৫ অক্টোবর নগরীর দক্ষিণ নালাপাড়ায় সুদীপ্ত বিশ্বাস হত্যা।

সুদীপ্ত চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ও চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে সদ্য এমবিএ পাস করেছিলেন। তার বাবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।

দিদারুল আলম মাসুম সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। অভিযোগ রয়েছে, ওই কলেজের পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নিতে তিনি কার্যক্রম শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে সুদীপ্তর ওপর হামলা। হামলাকারীরা সবাই লালখানবাজারের। ওই ঘটনায় প্রথম গ্রেপ্তার মোখতার কিংবা পলাতক পিচ্চি হানিফ দিদারুল আলম মাসুমেরই একান্ত সহযোগী। দিদারুল আলম মাসুমের ফেসবুকজুড়ে তার সঙ্গে তাদের সবার ছবির ছড়াছড়ি।

লালখানবাজার এলাকা বর্তমানে পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণে। পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই লালখানবাজার থেকেই ১১টি সিএনজি অটোরিকশায় করে দুর্বৃত্তরা দক্ষিণ নালাপাড়ায় গিয়ে সুদীপ্তকে খুন করে ফিরে আসে। এ পর্যন্ত যাদের নাম এ হত্যাকা-ের সঙ্গে উঠে এসেছে, তারা সবাই দিদারুল আলম মাসুমের কর্মী অথবা সহযোগী।

সুদীপ্ত হত্যা মামলায় প্রথম গ্রেপ্তার মোখতারের কাছে পুলিশ এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পেয়েছে। লালখানবাজার থেকে নালাপাড়া যাওয়ার মানচিত্রও উদ্ধার করেছে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, বড়ভাইয়ের নির্দেশে সুদীপ্তর ওপর হামলা করা হয়েছে। তবে কে এই বড়ভাই, তা এখনো পুলিশ বের করেনি।

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি অভিযোগ করেন, দিদারুল আলম মাসুম আওয়ামী লীগের সময়ই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের খুন করছেন। তিনি প্রশ্ন করেন, সুদীপ্তরা খুন হলে রাজনীতিতে আর কারা আসবে?

তিনি আরও অভিযোগ করেন, সুদীপ্ত হত্যার দিন দিদারুল আলম মাসুমের পিস্তল দিয়েই ফাঁকা গুলি করা হয়েছিল। পিস্তলের ফরেনসিক পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত হবে। নিয়ম অনুযায়ী লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে গুলির আগে কিংবা পরে তা নিকটবর্তী থানাকে অবহিত করতে হয়। কী কারণে গুলি করেছে তা লিখিতভাবে জানাতে হয়। দিদারুল আলম মাসুমের একটি শটগান ও একটি পিস্তল আছে।

দিদারুল আলম মাসুম সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালেই বিভিন্ন হত্যাকা-ের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে। রয়েছে ১৯৮৯ সালে লালখানবাজারে রিপন হত্যা, ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে মোমিন হত্যা, একই কলেজে ১৯৯৩ সালে মিজান হত্যা, ১৯৯৭ সালে লালখানবাজারে মুজিব হত্যা, ১৯৯৮ সালে কর্নার হোটেল মোড়ে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দেওয়া নিয়ে একটি (?) খুন, ২০১৫ সালে লালখানবাজার বাঘঘোনা পরিত্যক্ত ভবনে খোকন সরকারকে খুন, ২০১৭ সালের এপ্রিলে যুবলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে লালখানবাজারে মোহাম্মদ শরীফ ওরফে টেম্পু শরিফ এবং সর্বশেষ সিটি কলেজের কাছে সুদীপ্ত হত্যার অভিযোগ। এ ছাড়া ২০০০ সালে ঢাকায় সাজ্জাদ খুনের সঙ্গেও তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

১৯৯৭ সালের ৩১ জানুয়ারি নগরীর সিটি কলেজের পাশে ব্রাইট স্টার নামের একটি হোটেল থেকে দিদারুল আলম মাসুম সুইডেন আসলামের ৯ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন। তাদের কাছ থেকে দুটি বিদেশি রিভলবার, দুটি বিদেশি পিস্তল, একটি কাটা রাইফেল ও ২৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় জেল থেকে বেরিয়ে তিনি সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হন।

অন্যদিকে ওইদিন মাসুমের সঙ্গে গ্রেপ্তার সুইডেন আসলামের অন্যতম সহযোগী পিয়াল পরবর্তী সময় গুম হয়ে যান। তাকে আর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সিকান্দর হায়াত খান হত্যাচেষ্টা মামলারও অন্যতম আসামি ছিলেন।

সিকান্দর হায়াত খান হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হিসেবে জেলে থাকাকালীন সময়ে তিনি ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এমএ পাস করেন।

জানা যায়, নিহত মোমিন বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী ছিলেন। তিনি ছিলেন কমার্স কলেজ ছাত্র সংসদের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক। মোমিন খুন হওয়ার দিন দিদারুল আলম মাসুম বিভিন্ন স্থানে আ জ ম নাছির উদ্দীনকেও খোঁজাখুঁজি করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত নিরাপদ ছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন।

২০০১ সাল থেকে বিএনপি-জামায়াত পুরো সময় এবং পরবর্তী সময় ওয়ান-ইলাভেনের দুবছরসহ প্রায় আট বছর দিদারুল আলম মাসুম দেশের বাইরে ছিলেন। জানা যায়, ওই সময় তিনি ছিলেন দুবাই। সেখানেও নানা অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে জেল খাটেন। জামিনে বের হয়েই তিনি দেশে চলে আসেন।

১৯৯৮ সাল থেকে লালখানবাজার এলাকায় ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। জানা গেছে, এ ছাড়া আর কোনো বৈধ ব্যবসা না থাকা সত্ত্বেও চাঁদাবাজি ও দখল-বেদখলের সুবাদে লালখানবাজার এলাকায় ৩০ গ-া জায়গা, ২টি ফ্ল্যাট, একটি জিপ ও একটি প্রাইভেট কারের মালিক হয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন তিনি। বাবা ছিলেন জীবন বীমা কোম্পানির একজন কর্মচারী।

সিটি কলেজ নিয়ে তৎপরতা : জানা যায়, সুদীপ্ত হত্যার ছয় মাস আগে থেকেই সরকারি সিটি কলেজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন দিদারুল আলম মাসুম। তিনি ফেসবুকে মশিউর রহমান, মাহবুবুল হক সুমন ও ইফতেখারউদ্দিন ইফতুসহ বিভিন্ন নেতাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করতে থাকেন। এ নিয়ে কেউ কেউ পাল্টা লেখা, কখনো ওইসব লেখার জবাব দিতে থাকেন। সুদীপ্ত ছিলেন তাদের একজন।

এ ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজনই পুলিশকে বলেছেন, সুদীপ্তকে খুন করা সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য ছিল না। সুদীপ্ত হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার প্রথম যুবক মোখতার পুলিশকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানায়। পুলিশ মোখতারের কাছ থেকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার ম্যাপ ও ঘটনার ভিডিও উদ্ধার করে। তবে মোখতারের সঙ্গে দিদারুল আলম মাসুম ও স্থানীয় প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের একাধিক ছবি রয়েছে।

মেয়রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে মাসুমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না বলে প্রতিপক্ষের অভিযোগ। মোখতারের সঙ্গে দিদারুল আলম মাসুম ও স্থানীয় সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তোলা একাধিক ছবি রয়েছে।

এর বাইরেও সুদীপ্ত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সব আসামির সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা গেছে দিদারুল আলম মাসুমকে। লালখানবাজারে তার সমস্ত অপরাধ কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে পিচ্চি হানিফ ও ওয়াসিম দুই ভাই। দুই ভাই-ই সুদীপ্ত হত্যা মামলার আসামি। তাদের বাবা মতিঝর্না বস্তিতে কখনো সবজি বিক্রি, কখনো রিকশা চালান। তবে দুই ভাইয়ের বিলাসবহুল চালচলন দেখে তা বোঝা দায়।

পিচ্চি হানিফ মাসুম বাহিনীর অস্ত্রভা-ারের নিয়ন্ত্রক। লালখানবাজারে নির্মাণাধীন সব বাড়ির সরবরাহ কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন হানিফ। ওয়াসিম সমস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসা, বাজার, অটোরিকশা থেকে দৈনন্দিন চাঁদা আদায় ও মতিঝর্না এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন।

দিদারুল আলম মাসুমের বক্তব্য : অভিযোগ প্রসঙ্গে দিদারুল আলম মাসুম বলেন, আমি যখন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে মাঠে হেফাজতকে প্রকাশ্যে গুলি করেছিলাম, তখন আমার বিপক্ষে কথা বলা লোকজন মাঠে নামতে পারতেন না। হেফাজত মাঠ দখল করে রেখেছিল। তার সঙ্গে সন্ত্রাসীদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে মাসুম বলেন, আমি রাজনীতি করি। আমার সঙ্গে মস্তান, গু-া অনেকেই থাকতে পারে।

মুসল্লিও তো থাকে। তিনি ছাত্রলীগের নগর সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির সমালোচনা করে বলেন, রনি একটি মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তিনি আমাকে নিয়ে যা-তা বলছেন। এটা তিনি বলতে পারেন না। তিনি ব্যালট বাক্স ছিনতাই করতে গিয়ে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর আমি অস্ত্র ব্যবহার করেছি হেফাজতকে দৌড়াতে।

আমাদের সময়

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin