এ যেন এক যুদ্ধের মতো। লড়াইয়ের ময়দানে প্রতিপক্ষ পর্যুদস্ত, পরাহত। তার তলোয়ার পড়ে গেছে, তিনি এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। কিন্তু বীর সৈনিক যিনি বিজয়ী হতে চলেছেন তিনি মোটেও নির্মম নন। যখন দেখলেন তার প্রতিপক্ষ রক্তাক্ত এবং অসহায় তখন তিনি তার নিজের তলোয়ার ছুড়ে ফেলে দিলেন, টেনে তুললেন অসহায় প্রতিপক্ষকে। তাকে বাঁচতে দিলেন।
কিন্তু ইতিহাস বলে এরকমভাবে দুর্বল প্রতিপক্ষকে যখন বাঁচতে দেওয়া হয়, তখন সেই দুর্বল প্রতিপক্ষই চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে, পিছন থেকে আঘাত করে। সেরকমটাই কি ঘটবে শেখ হাসিনার এই উদারতায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, শেখ হাসিনা কি ভুল করলেন? গতকাল ২৫ মার্চ শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকারের নির্বাহী আদেশে বেগম খালেদা জিয়া ছয়মাসের জন্য মুক্ত হয়েছেন। তার দণ্ড ছয়মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই শেখ হাসিনা নিয়েছেন স্বীয় বিচার বিবেচনা, মহানুভবতা এবং উদারতা থেকে। কিন্তু এই উদারতার মূল্য কি খালেদা জিয়া বুঝবেন?
যদি কেউ মনে করে থাকে যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি দুর্বল হয়ে গেছে, বিএনপি এখন আগের মতো সংগঠিত নয়, আগের মতো শক্তিশালী নয়- তারা মহাভুল করবেন। বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল নয়। বিএনপি বাস্তব অর্থে একটি আওয়ামী লীগ বিরোধী প্লাটফরম। বিএনপির যদি কোনো সংগঠনও না থাকে তাহলেও আওয়ামী লীগ বিরোধীদের একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে থাকবে বিএনপি। আর বাংলাদেশে আওয়ামী বিরোধী অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী রয়েছে সেটা সবাই জানে।
তাই আজকে অসহায় আর্তনাদ করাই বেগম জিয়া যে আগামীকাল বিশ্বাসঘাতক সর্পিনী হয়ে উঠবেন না, সেই কথা কি কেউ হলফ করে বলতে পারে? খালেদা জিয়া যে ৬ মাসের সুযোগ পেলেন, এই ৬ মাসে তিনি তার দলকে পুনর্গঠিত করতে পারেন। কারণ বিএনপির পক্ষ থেকে আগে বার বার বলা হতো যে খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ, মরনাপন্ন।
তিনি চলাফেরাই করতে পারছেন না। কিন্তু গতকাল এক লহমাতেই বোঝা গেলো যে বেগম জিয়া সম্পর্কে বিএনপি নেতারা যা বলেছেন, তার সবই মিথ্যা বানোয়াট এবং অসত্য। কারণ বেগম জিয়া গাড়িতে উঠে যখন মিটিমিটি হাসছিলেন, তখন তার চেহারার মধ্যে গুরুতর অসুস্থতার কোনো নজিরই ছিল না। বরং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকেরা যেটা বলছিলেন, খালেদা জিয়ার অসুখটা মূলত বার্ধক্যজনিত। সেটাই সত্যি।
শেখ হাসিনা কি তবে বেগম জিয়াকে দুর্বল ভেবে ভুল করলেন? খালেদা জিয়ার মুুক্তির পরে বিএনপি নেতাদের মনোবল চাঙা হবে।
দেশের অর্থনীতিতে এখন সংকটের ঘনঘটা। করোনাভাইরাসের কারণে জনমনে এখন উৎকষ্ঠা অস্বস্তি। এই অস্বস্তি যেকোনো সময়ে জনরোষে রূপান্তরিত হতে পারে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন। কারণ করোনাভাইরাসের প্রকোপ যদি দীর্ঘমেয়াদী হয় তাহলে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে, বেকারত্ব বাড়বে, সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে এবং এই সবগুলোকেই জনসন্তোষের দিকে নিয়ে যাবে।
সরকারের বিরুদ্ধে গত ৬-৭ বছরে কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কারণ বিরোধীদলের নেতৃত্বের ব্যর্থতা ছিল। ড. কামাল হোসেন নেতা হিসেবে নিজেকে অযোগ্য প্রমাণ করতে একটুও কার্পণ্য করেননি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কখনো জাতীয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। অন্যান্য নেতৃবৃন্দও কোনো কারিশমা দেখাতে পারেননি।
এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে বিএনপিতে খালেদা জিয়াই নেতা। তার পুত্র তারেক জিয়ার লাম্পট্য, দুর্নীতির কারণে তার ইমেজ অত্যন্ত নেতিবাচক। গত এক দশকে বিএনপি যে কোনো সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি তার প্রধান কারণ হলো বিএনপিতে কোনো নেতা ছিল না। খালেদা জিয়া যদি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিও ঘোষণা না করেন, কোনো রাজনৈতিক বক্তৃতাও না দেন, তিনি শুধু কারাগারের বাইরে আছেন, এটুকুই কি আওয়ামী বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদেরকে চাঙা করার জন্য যথেষ্ট নয়?
খালেদা জিয়া বাইরে থাকার ফলে বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়বে। করোনার কারণে যে অর্থনৈতিক সংকট, সেটাকে তারা রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করবে- এটা না ভাবার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে যারাই প্রতিপক্ষকে উপেক্ষা করেছে, অবজ্ঞা করেছে, দুর্বল করেছে, তারাই বিপদে পড়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যে সহমর্মিতা, পারস্পরিক সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা সেটা বাংলাদেশের নেই। যেদেশে ক্ষমতাসীন দল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালায়, যেদেশে জাতির পিতাকে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল স্বীকৃতি দেয় না, জাতির পিতার জন্মদিনে নির্মম উৎসব করে, যেদেশে আত্মস্বীকৃত খুনিদেরকে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল কূটনৈতিক চাকরি দেয় এবং জামাই আদর করে রাখে- সেদেশে এরকম রাজনৈতিক উদারতা, এরকম ক্ষমা প্রদর্শনের উদারতা কি কেউ বুঝবে? নাকি এজন্য শেখ হাসিনাকে বড় মাশুল দিতে হবে?
সূত্র: বাংলা ইনসাইডার