আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মনে হচ্ছে তিনি খালেদা জিয়ার প্রতি নমনীয়। যিনি ১৭ বছরের জন্য কারাগারে দণ্ডিত হয়েছেন, তাকে নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত করে ৬ মাসের জন্য জামিন দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন আবার নতুন করে ৬ মাস মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি শুধু বিরল ঘটনা নয়, অভাবনীয় একটা ঘটনাও বটে। বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার এমন একজন প্রতিপক্ষ, যে কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়। বেগম খালেদা জিয়া পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে তাঁর ভুয়া জন্মদিন পালন করতেন।
দীর্ঘদিন এই বিভৎস কেক কাটার উৎসব করে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি চরম অবমাননা প্রকাশ করতেন। বেগম খালেদা জিয়া একানব্বইয়ের সরকার প্রধান হয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেননি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচারের কোন উদ্যোগ তিনি নেননি। বরং বেগম খালেদা জিয়া একানব্বই সালে দায়িত্ব গ্রহণ করে পঁচাত্তরের আত্নস্বীকৃত খুনীদের পৃষ্টপোষকতা দিয়েছেন। তাদের চাকরিতে পদোন্নতি দিয়েছেন।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনে তাদেরকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে পবিত্র সংসদে নিয়ে এসে কলংকিত করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়েই একুশে আগস্টের বিভৎস গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে।
বেগম খালেদা জিয়া কেবল রাজনৈতিকভাবে শেখ হাসিনাকে পরাস্থ করতে চাননি, বরং সন্ত্রাস এবং অপরাজনীতির মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিলেন। আর এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সৌজন্যতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ- সেই জায়গাটি অপসারিত হয়ে গিয়েছিলো।
শেখ হাসিনা সেই জায়গাটি আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছেন। তার চরম প্রতিপক্ষ, যিনি রাজনৈতিকভাবে নয়, পেশীশক্তির মাধ্যমে তাকে নিঃশেষ করতে চান, তার প্রতিই উদারতা দেখাচ্ছেন শেখ হাসিনা।
রাজনৈতিক অঙ্গনে তাই বড় প্রশ্ন, খালেদা জিয়ার প্রতি শেখ হাসিনা নমনীয় কেন? এর উত্তরগুলো খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় যে, অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যে কারণগুলো হয়তো শেখ হাসিনাকে এরকম নমনীয় হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এর মধ্যে যে প্রধান ৫ টি কারণ রয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তা হলো;
বঙ্গবন্ধুর স্নেহ
বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানী এবং শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটা অনন্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেই গ্রন্থটির শিরোনাম হলো ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’।
সেই গ্রন্থে স্বাধীনতার পর খালেদা জিয়ার সম্পর্কে কিছু কথা বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পর বেগম খালেদা জিয়াকে ঘরে নিতে চাননি তার স্বামী জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছিলেন, দাওয়াত দিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের যে বিরোধ তা মিটিয়ে দিয়েছিলেন।
সেখানে ওয়াজেদ মিয়া এটাও উল্লেখ করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু তাকে শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সভাপতিও একাধিক বক্তৃতায় এই ঘটনাটির স্মৃতিচারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে ভালো শাড়িটি খালেদা জিয়াকে দিয়েছিলেন। কাজেই বঙ্গবন্ধুর যে উদারতা এবং স্নেহ, সেটিকে ধারণ করেন শেখ হাসিনা। এ কারণেই খালেদা জিয়ার প্রতি তিনি রুঢ় আচরণ বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হননি বলে অনেকে মনে করেন।
একসঙ্গে আন্দোলন
বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ ৯ বছর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছেন শেখ হাসিনা। যদিও সেই আন্দোলনের রুপপরিকল্পনা, আন্দোলনের নেতৃত্বদান এবং জনগনকে সংগঠিত করেছিলেন শেখ হাসিনা একাই। কিন্তু বিএনপির নেতা হিসাবে সে সময় বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনা দু-দফা বৈঠকও করেছিলেন। স্বৈরাচার হটানোর জন্য একসঙ্গে কাজ করেছেন, সেই বিবেচনা বোধ থেকে হয়তো বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি শেখ হাসিনা কিছুটা নমনীয়।
মানবিক মানুষ
শেখ হাসিনা একজন মানবিক মানুষ, মানবিক ব্যক্তিত্ব। রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আশ্রয় দেওয়া তার বড় একটি প্রমাণ। শুধু রোহিঙ্গা নয়, সারাজীবন তিনি মানবতার সেবা করেছেন, মানবতার চর্চা করেছেন এবং অসহায়, দু:স্থ, নিরীহ মানুষের পাশে শেখ হাসিনা যেভাবে দাঁড়ান তা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বে একটা বিরল দৃষ্টান্ত। আর এই মানবতা থেকেই হয়তো শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার প্রতি নমনীয় আচরণ করেছেন।
প্রতিহিংসাপরায়ণ নন
শেখ হাসিনার রাজনীতিতে কখনো প্রতিহিংসা দেখা যায় না। তিনি পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ট্রাজেডির পর ১৯৮১ সালে দেশে এলেন, তখন যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভায় অংশ নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। বরং তাদেরকে দলে রেখেছেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের পর একানব্বইয়ে যখন ড. কামাল হোসেনরা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তখন শেখ হাসিনা কোন প্রতিহিংসার আশ্রয় নেননি।
ওয়ান ইলেভেনের সময় যারা তার প্রতি অবিচার করে তাকে মাইনাস করতে চেয়েছেন, তাদেরকেও শেখ হাসিনা এক ধরণের ক্ষমা করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনার এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর জন্যই তিনি হয়তো খালেদা জিয়ার প্রতি নমনীয়।
রাজনৈতিক দুরদর্শিতা
খালেদা জিয়ার প্রতি নমনীয় থাকার একটি বড় কারণ হতে পারে রাজনৈতিক দুরদর্শিতা। শেখ হাসিনা জানেন যে, প্রতিহিংসার চেয়ে ক্ষমা মহত্বকে উদ্ভাসিত করে। খালেদা জিয়ার প্রতি শেখ হাসিনার নমনীয় হওয়ার কারণে তার ইমেজ বা ভাবমূর্তি আরো উজ্জল হয়েছে।
যেমন ২০১৪ সালে তিনি সংলাপের জন্য খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেছিলেন। এই সংলাপ প্রত্যাখ্যান করে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের যেমন ভরাডুবি হয়েছে তেমনি নতুন উচ্চতায় উঠেছেন শেখ হাসিনা। আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর শেখ হাসিনা ছুটে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে।
কিন্তু সেই সময় খালেদা জিয়া বাড়ির প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়ে আরেকটি নিকৃষ্ট অশোভন শিষ্টাচার বহির্ভূত কাণ্ড করেছেন। এজন্য তাকে মূল দিতে হয়েছে। সেখানেও শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক দুরদৃষ্টিতার প্রমাণ রেখেছেন। জনগনের কাছে তার ভাবমূর্তি আরো উজ্জল হয়েছে।
নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়ার ঘটনার পর জনগন শেখ হাসিনার বন্দনাই করছে, শেখ হাসিনার প্রশংসা করছে। শেখ হাসিনাকে দলমতের ঊর্ধ্বের একজন নেতা হিসাবে বিবেচনা করছেন। এই রাজনৈতিক দুরদৃষ্টিতার কাছে খালেদা জিয়া পরাজিত হচ্ছেন। প্রতিশোধ নিয়ে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া যত কঠিন, তার চেয়ে কঠিন হলো ক্ষমা করে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া। শেখ হাসিনা সেই কঠিনতর পথেই বিজয় অর্জন করেছেন।
সূত্র: বাংলা ইনসাইডার