সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিচারে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড অনুসরণ করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ব্রিটেনের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডস-এর রক্ষণশীল দলের ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য অ্যানথিয়া ম্যাকনিটায়ার।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে অ্যানথিয়া ম্যাকনিটায়ার এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারের বিষয়ে বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে বলতে চাই, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারারুদ্ধ করার বিষয়টি আমার মনোযোগে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়ায় বিচার লাভের অধিকার রয়েছে। দেশটিতে বিচার বিভাগকে হতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। একটি নিরপেক্ষ আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে সাধারণ নাগরিকরা কিংবা বেগম জিয়ার মতো বিশিষ্ট নাগরিক যে-ই হোন তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার লাভ করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়াবলি নিয়ে আমার যে আগ্রহ রয়েছে তার অংশ হিসেবে আমি বেগম জিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ বজায় রাখবো।’
আরো পড়ুন…
খালেদা জিয়ার আইনজীবী লর্ড কারলাইলের
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের পরামর্শ ও সহযোগিতার জন্য ব্রিটেনের এক আইনজীবীকে নিয়োগ দিয়েছে দলটি। তিনি খালেদা জিয়ার ৩৬টি মামলায় পরামর্শ ও সহযোগিতা করবেন।
মঙ্গলবার দুপুরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই কথা জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এসময় মির্জা ফখরুল জানান, বিদেশী এ আইনজীবীর নাম লর্ড কারলাইল। ব্রিটেনে যারা আমাদের রাজনীতির সমর্থক রয়েছেন তাদের সাথে আলোচনা করে এ ব্রিটিশ আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ হাউস অব লর্ডসের স্বতন্ত্র সদস্য কারলাইল ব্রিটেনের শীর্ষ আইন বিশেষজ্ঞদের অন্যতম। পোলিশ ইহুদি অভিবাসী পরিবারে তার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে আইনে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন ১৯৬৯ সালে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি ‘কুইন’স কাউন্সেল (কিউসি)’ নিযুক্ত হন। লর্ড কারলাইল একজন ব্যারিস্টার এবং লন্ডনের শীর্ষস্থানীয় ব্যারিস্টারদের চেম্বার ‘ফাউন্ড্রি চেম্বারসের সাবেক প্রধান।
নির্বাসিত বা নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর বিষয়ে লর্ড কারলাইলের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এ ধরনের এমন অনেক প্রতিষ্ঠান তার পরামর্শ নিয়ে থাকে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক সংগঠনকে আমেরিকায় আইনি ভিত্তির বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। নির্দেশনা দেওয়া ছাড়াও মার্কিন আইনজীবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি আইনজীবী ও কর্মকর্তাদের কাছে সংগঠনটির আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন তিনি।
সাধারণত গুরুতর অপরাধ, স্থানীয় সরকার এবং লাইসেন্স, পরিকল্পনা ও পেশাগত নিয়ম-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সরকারি আইনের মামলায় বেশি অংশ নিয়ে থাকেন লর্ড কারলাইল। সংসদীয় অধিকার ও আচরণ সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এছাড়া বড় ধরনের বাণিজ্যিক প্রতারণার মামলায়ও পারদর্শী তিনি। এমন অনেক মামলায় নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে তাকে।
এছাড়া লর্ড কারলাইলব্রিটিশ গোয়েন্দা সেবা প্রতিষ্ঠান এম-সিক্সটিনের সাবেক প্রধান স্যার জন স্কারলেটের সঙ্গে মিলে কৌশল ও রাজনৈতিক ঝুঁকি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান এসসি স্ট্র্যাটেজি লিমিটেড পরিচালনা করছেন লর্ড কারলাইল।
সম্প্রতি কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন লর্ড কারলাইল। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার বণ্টন নিয়ে গভীর আগ্রহ রয়েছে এই সংস্থার। তিনি নিজেও এ বিষয়ে অনেক আগ্রহী।
২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের স্বাধীন পর্যবেক্ষক ছিলেন দেশটির এই আইনজীবী। জাতীয় নিরাপত্তায় অবদানের জন্য ২০১২ সালে তাকে সম্মানসূচক কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (সিবিই) নিয়োগ দেওয়া হয়।
মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক মামলায়ও লর্ড কারলাইলের বেশ আগ্রহ রয়েছে। হাভার্ড লিগ ফর পেনাল রিফর্মের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০৬ সালে বেশকিছু তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। তাকে ওই সময় জেলখানায় শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ওপর নির্যাতন, ফাঁদ অনুসন্ধান ও শিশুদের বিভিন্ন মামলা তদন্ত করতে হয়েছিল।
লর্ড কারলাইল পেশাগত জীবনে রাজনীতিক হিসেবেও সফল। ওয়েলসের লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক দলের সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও ১৯৮৩ থেকে ’৯৭ পর্যন্ত মন্টোগমেরিশায়ার এলাকা থেকে পার্লামেন্ট মেম্বারের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। ১৯৯২ সালে দলের বেহাল অবস্থায় নেতৃত্বে এসেছিলেন তিনি। এরপর ওয়েলসের লেবার পার্টির সঙ্গে দায়িত্ব হস্তান্তরের আলোচনার অন্যতম ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেন এই আইনজীবী। ১৯৯৭ সালে ক্ষমতা বিষয়ে গণভোটের ব্যাপারেও নেতৃত্ব দেন তিনি।
২০১৭ সাল পর্যন্ত লিবারেল ডেমোক্রেটিক দলের সম্মানিত সদস্য থাকাকালে জাতীয় নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলীয় নীতির সঙ্গে বিরোধ হয় কারলাইলের। এ কারণে দল থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। সেই সময়ের খবরে বলা হয়েছিল— বেসামরিক স্বাধীনতা বিশেষ করে তথাকথিত ‘স্নুপারস চার্টার্স’ বিষয়ে দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিরোধের কারণেই দল ছাড়েন তিনি।
ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, হাইকোর্টের সহকারী বিচারক, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন লর্ড কারলাইল। হোয়াইট অ্যাসাইন অ্যাসোসিয়েশনের ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য তিনি। ২০০৬ সালে হাভার্ড দণ্ডবিধি সংস্কার কমিটির সভাপতি পদেও পাওয়া গেছে তাকে। প্রথম সংসদ সদস্য হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি।
কারলাইলের নিয়োগ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলার মধ্যে একটি মামলায় বেআইনি ভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। লর্ড কারলাইল দীর্ঘদিন ধরে আইনি পেশার পাশাপাশি রাজনীতির সাথেও জড়িত। লর্ড কারলাইল খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনায় আইনজীবী টিমের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরে আনন্দিত। এখন থেকে লর্ড কারলাইল দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলায় পরামর্শ ও সহযোগিতা করবেন। প্রয়োজনে তিনি বাংলাদেশেও আসবেন।
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গত সপ্তাহে ব্যক্তি উদ্যোগে বাংলাদেশবিষয়ক সেমিনার আয়োজন করে আলোচনায় এসেছেন লর্ড কারলাইল। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা অংশ না নেওয়ায় সেটি কার্যত বিএনপি ও জামায়াতের একতরফা অভিযোগ জানানোর মঞ্চে পরিণত হয়। এছাড়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের শুরু থেকেই কারলাইল ছিলেন তার বিরোধী। ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের ভূমিকাকে ‘প্রতিশোধমূলক’ বলে অভিযোগ করে দক্ষিণ আফ্রিকা ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের মতো ‘ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের নীতি’ অনুসরণ করার আহ্বান জানান কারলাইল।