সোমবার রাতে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী ২০ দলীয় জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠকটি রাত ৯টার দিকে শুরু হয়ে চলে রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত। এতে সভাপতিত্ব করেন বেগম খালেদা জিয়া।
বৈঠকে কয়েকটি এজেন্টার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপ-নির্বাচন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জোটের এমন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৈঠকের অধিকাংশ বিষয় সময়জুড়ে আলোচ্য বিষয় ছিল (ডিএনসিসি) উপ-নির্বাচন।
প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা উঠলে সবাই কমবেশি কথা বলেন জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্য এক শীর্ষনেতা জানান, জোটের বৈঠকে তিনটি বিষয়ে আলোচনা হয়। এতে প্রধান বিষয় ছিল ডিএনসিসি উপ-নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে। জোটের শরিকরা প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিষয়ে খালেদা জিয়াকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি যাকে মনোনয়ন দেবেন, তার জন্যই জোটের শরিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন বলে বৈঠকে নেতারা একমত হয়েছেন।
ওই সূত্রটি জানায়, বৈঠকে মো. সেলিম উদ্দিনকে জামায়াতের মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে দলটির উদ্যোগে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়। জোটের একজন সিনিয়র নেতার ভাষ্য, জামায়াতের প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে কমবেশি সবাই আলোচনা করেছেন। সবাই বলেছেন, হঠাৎ করে তারা কেন প্রার্থী দিলো।
তবে শরিকদের আলোচনার পর জামায়াতের প্রতিনিধি দলটির নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম বৈঠকে বলেন, আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী দিয়েছি। এটি চূড়ান্ত নয়। বিষয়টি বিবেচনা করা যাবে।
পরে আলোচনার এক পর্যায়ে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি মীমাংসা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
গত ৩ জানুয়ারি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ঢাকা উত্তরের আমির মো. সেলিম উদ্দিনকে ডিএনসিসি নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়।
বিস্তারিত আলোচনা শেষে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপ-নির্বাচনে একক প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। এক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী একক প্রার্থী মনোনয়নে বিষয়টি মীমাংসা করতে জোট-সমন্বয়ক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনার ভার দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও সোমবারের বৈঠকে খালেদা জিয়াকে ছাড়া কোনও অবস্থাতেই নির্বাচনে অংশ না নেওয়া এবং রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।
সূত্র জানায়, বৈঠকে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম ডিএনসিসি নির্বাচনের জন্য তাবিথ আউয়াল বা আন্দালিব রহমান পার্থের নাম প্রস্তাব করেন।
সূত্রের দাবি, কোনও কোনও নেতা তাবিথ আউয়ালের নাম উচ্চারণ করলেও অনেকেই কারও নাম উল্লেখ করেননি।
তবে আন্দালিব রহমান পার্থ তার বিষয়ে বৈঠকে বলেন, ‘আমি মনে করি, বিএনপির প্রার্থী বেস্ট প্রার্থী। ডিএনসিসি উপ-নির্বাচনে মূল লড়াই হবে ধানের শীষ ও নৌকায়। এক্ষেত্রে বিএনপির প্রার্থী হলেই বেস্ট। ফলে, ম্যাডাম যাকে দেবেন, তার জন্যই একসঙ্গে কাজ করব আমরা।’
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক একটি দলের চেয়ারম্যান জানান, জোটের বৈঠকে ডিএনসিসির পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তাকে ছাড়া আগামীতে কোনও নির্বাচনে যাবে না জোট, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বৈঠকে খালেদা জিয়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছেন। জোটের শরিকদের এ নির্বাচনে না ডাকার বিষয়ে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বলে দাবি এক নেতার।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রতিনিধি মুফতি ওয়াক্কাছ বলেন, ‘বৈঠকে ডিএনসিসি নির্বাচনের প্রার্থী নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছে। জামায়াতের যে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে, তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করি ‘
বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য আবদুল হালিম, জাতীয় পার্টির মোস্তফা জামাল হায়দার, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, জাগপার সভাপতি রেহানা প্রধান, ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, পিপলস লীগের চেয়ারম্যান গরীবে নেওয়াজ, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, ইসলামীঐক্য জোটের অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব, খেলাফত মজলিসের আহমদ আবদুল কাদের, ন্যাপ ভাসানীর আজাহারুল ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (একাংশ) মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী, ডেমোক্রেটিক লীগের সাইফুদ্দিন মনি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির মঞ্জুর হোসেন ঈসা, সাম্যবাদী দলের সাইদ আহমেদ এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জোটের শরিক লেবার পার্টির মধ্যে নেতৃত্বের বিভক্তির কারণে তাদের কোনও পক্ষকেই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
এর আগে গত ১৫ নভেম্বর ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক হয়।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং নতুন যুক্ত হওয়া উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ৩৬ ওয়ার্ডের নির্বাচনের তফসিল মঙ্গলবার ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দুপুর ১২টায় নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে এ তফসিল ঘোষণা করা হবে। খসড়া তফসিল অনুয়ায়ী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ১৮ বা ২১ জানুয়ারি। মনোনয়ন বাছাই ২৪ থেকে ২৫ জানুয়ারি এবং ভোট গ্রহণ ২৬ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচন কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ভোট গ্রহণের জন্য একটি খসড়া কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে ইসি। এ ছাড়া ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ডিসিসি নির্বাচনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটিতে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকবেন ২৭ হাজার ৮১৭ জন কর্মকর্তা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে দায়িত্বে থাকবেন ২৩ হাজার ৮৬৪ জন। দক্ষিণের ১৮ ওয়ার্ডে থাকবেন ৩ হাজার ৯৫৩ জন। দুই সিটির নির্বাচনে প্রায় ৩৬ হাজার ৭৬৮ সদস্য আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবেন। এর মধ্যে বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ৩১ হাজার ১২৩ জন থাকবেন ঢাকা উত্তরে। দক্ষিণে থাকবেন প্রায় ৫ হাজার ১৫৩ জন। সাধারণ ভোট কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকবেন ২২ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। গুরুত্বপৃর্ণ কেন্দ্রে থাকবেন ২৪ জন করে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির উপনির্বাচনের তফসিলে মনোনয়নপত্র জমার জন্য দু’টি তারিখ পছন্দ ইসির। প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় ১৮ জানুয়ারি বা ২১ জানুয়ারি হতে পারে। মেয়র এবং কাউন্সিলর পদে ভোট যেহেতু একই দিনে তাই মনোনয়ন দাখিলের শেষ তারিখও এক সাথে রাখা হচ্ছে।
গত ৩০ নভেম্বর আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর ১ ডিসেম্বর ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদটি শূন্য ঘোষণা করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সে ক্ষেত্রে ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ উপনির্বাচন করতে হচ্ছে ইসিকে। মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করার গেজেট হাতে পাওয়ার পর নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে ইসি সচিবালয়।
সর্বশেষ চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সাধারণ ওয়ার্ড ৫৪টি, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৮টি। ভোটার ২৯ লাখ ৭৯ হাজার ১০৭, এর মধ্যে পুরুষ ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪০, মহিলা ১৪ লাখ ৩৩ হাজার ১৬৭। ভোটকেন্দ্র ১ হাজার ৩৪৯, ভোটকক্ষ ৭ হাজার ৫১৬। ঢাকা দক্ষিণে ১৮ ওয়ার্ডে ভোটার ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৪২১, এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৪৬ হাজার ৩৮১, মহিলা ২ লাখ ৩৩ হাজার ৪২১ জন। ভোটকেন্দ্র ২৩৩, ভোটকক্ষ ১ হাজার ২৪০টি।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটির বাড্ডা ইউনিয়ন থেকে যুক্ত হয়েছে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড, ভাটারা ইউনিয়নে ৩৯ ও ৪০ ওয়ার্ড, সাঁতারকূল ইউনিয়নের ৪১ নম্বর ওয়ার্ড, বেরাইদ ইউনিয়নে ৪২ নম্বর ওয়ার্ড, ডুমনি ইউনিয়নে ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড, উত্তরখান ইউনিয়নে ৪৪, ৪৫ ও ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড, দক্ষিণখান ইউনিয়নে ৪৭, ৪৮, ৪৯ ও ৫০ নম্বর ওয়ার্ড এবং হরিরামপুর ইউনিয়নে ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড। অন্য দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল, সারুলিয়া, ডেমরা, মান্ডা, দক্ষিণগাঁও ও নাসিরাবাদ ইউনিয়ন থেকে ডিএনসিসিতে যুক্ত হওয়া ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬১, ৬২, ৬৩, ৬৪, ৬৫, ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭১, ৭২, ৭৩, ৭৪ ও ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড।
এ দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং নতুন যুক্ত হওয়া উত্তর-দক্ষিণের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচন পরিচালনার জন্য বাজেট ধরা হয়েছে ১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা খাতে বরাদ্দ ৯ কোটি টাকা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দ ৬ কোটি টাকা।