জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন চলছে। মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার পক্ষে তৃতীয় দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন সিনিয়র আইনজীবী আবদুর রেজ্জাক খান।
তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ না হওয়ায় আদালত বুধবার (আজ) যুক্তিতর্ক উপস্থানের জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করেন। ওই দিন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলারও শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
রাজধানীর বকশিবাজারে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান এ দিন ধার্য করেন। আদালতে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন খালেদা জিয়া। এক কাপ রঙ চা পান করেই এদিন পার করলেন তিনি।
এদিন দুই মামলায় হাজিরা দিতে খালেদা জিয়া বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে এজলাসে ঢোকেন। বেলা ১১টা ২৯ মিনিটের দিকে বিচারক এজলাসে প্রবেশের পর অনুমতি নিয়ে তিনি নির্ধারিত আসন গ্রহণ করেন। এর পরই খালেদা জিয়ার পক্ষে তৃতীয় দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন কার্যক্রম শুরু হয়।
বাদীপক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও উচ্চ আদালতের রেফারেন্স উলে্লখ করে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে আবদুর রেজ্জাক খান বলেন, এই মামলা হল সোনালী ব্যাংক কর্পোরেট শাখায় একটি বিদেশি অনুদান সম্পর্কে।
মূল ডিমান্ড ড্রাফ&ট (ডিডি) সেৌদি আরব থেকে এসেছে। সোনালী ব্যাংকের একটি ডকুমেন্টও এক্সিবিউট (প্রদর্শন) হয়নি। আমরা সব সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছি যে, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এতিম তহবিল বলে কোনো তহবিল ছিল না।
আবার সাক্ষীরা বলেছেন, মূল ফাইল তারা কখনও চোখে দেখেননি। সোনালী ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা বলেছেন, দুদক কর্মকর্তা এ সংক্রান্ত কাগজপত্র চেয়েছিল।
কিন্তু তা নেই বলে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন তারা। সোনালী ব্যাংকের একজন সাক্ষীও বলেননি, খালেদা জিয়া ওই অ্যাকাউন্ট খুলেছেন অথবা তিনি ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলেছেন। খালেদা জিয়া টাকার ধারেকাছেও নেই।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে একটি বিরাট অর্গানোগ্রাম আছে। তার সময় (খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন) সেখানে সচিব পর্যায়ের, মুখ্য সচিব পর্যায়ের ১৫ জন পরিচালক ছিলেন।
তাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার অভিযোগ আসিনি যে- এই টাকা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এতিম তহবিলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বা অন্য কোন স্থান থেকে টাকা এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী (সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া) ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এটা কোনো সাক্ষী বলেননি। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারি কিংবা অন্য কোনো দালিলিক প্রমাণ, কোনো কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি দুদক প্রসিকিউশন।
তিনি পারিবারিক ঠিকানা ব্যবহার করেছেন, আর এটাই কি ক্ষমতার অপব্যবহার হল? তিনি আরও বলেন, এ মামলার চার্জ গঠনের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ও পরে আপিলে গিয়েছিলাম।
মামলার যে চার্জ তৈরি করা হয়েছে, তা টাইপ অফ অকারেন্স ও সময়ের বাইরে গিয়ে চার্জ গঠন করা হয়েছে। এ মামলার এফআইআর ও চার্জশিটে ঘটনাস্থল ও সময় ভিন্ন ভিন্ন।
সিনিয়র আইনজীবী আরও বলেন, একই ধারাবাহিকতায় যদি একই অপরাধ হয়ে থাকে। তাহলে তাদের একসঙ্গে বিচার হতে পারে। এই মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা আছেন, তাদের সঙ্গে যোগসাজসের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
তাদের কাউকেই খালেদা জিয়া চেনেন না। কোনো সাক্ষীও বলেননি যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারও কোনো সম্পর্ক ছিল। এদিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে হলে আদালত পরবর্তী যুক্তিতর্কের জন্য দিন ধার্য করেন।
এক কাপ রঙ চায়েই দিন পার : এদিন বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত আদালতে মামলার কার্যক্রম চলে। দুপুর ১টা ১৮ মিনিটের দিকে এক ঘণ্টার জন্য বিরতি দেন আদালত।
এরপর আদালতের ভেতরেই ছোট্ট একটি রুমে বিশ্রাম নেন খালেদা জিয়া। মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস যুগান্তরকে বলেন, বিরতির সময় খালেদা জিয়া জোহরের নামাজ আদায় করেন।
এরপর তিনি এক কাপ রঙ চা পান করেছেন। কোনো খাবার খাননি তিনি। এ সময় আদালতের এজলাসে অন্য আইনজীবীদেরও দুপুরের খাবার খেতে দেখা যায়।
এরপর বিরতি শেষে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটের দিকে আবার আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। তৃতীয় দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থান শেষ হলে বিকাল ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে খালেদা জিয়া আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে যান। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি এক কাপ রঙ চা ছাড়া আর কিছুই খাননি।
এদিকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলায় কোনো সারবত্তা নেই। এটি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা।
এ মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার সাক্ষ্য নেই। তিনি এ ট্রাস্টের সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন তাও প্রমাণিত নয়। আমরা আশা করছি, এ মামলায় তিনি খালাস পাবেন।
আদালতে ৩২ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা কেউই বলেননি খালেদা জিয়া এ মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর আগে চলতি বছরের ২০ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন আবদুর রেজ্জাক খান।
এরও আগে ১৯ ডিসেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াসহ সব আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে আসামিদের সর্বোচ্চ শাসি্ত দাবি করে দুদক প্রসিকিউশন।
খালেদা জিয়ার হাজিরা উপলক্ষে এদিনও আদালত চত্বরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়। আদালতের প্রবেশমুখেই ছিল আর্চওয়ে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো।
এ ছাড়া আদালত প্রাঙ্গণে এসি প্রিজনভ্যানও লক্ষ করা গেছে। এদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আবদুল আউয়াল মিন্টু, রুহুল কবির রিজভী, মির্জা আব্বাস প্রমুখ।
এ ছাড়া খালেদা জিয়ার আইনজীবী হিসেবে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, এজে মোহাম্মদ আলী, এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদারসহ শতাধিক আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রাজধানীর রমনা থানায় প্রথম মামলাটি করা হয়।
আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগঁাও থানায় দ্বিতীয় মামলাটিও করে দুদক।
উৎসঃ যুগান্তর