শ্রীলঙ্কার রানের বানে ভাসল বাংলাদেশ
সকাল থেকেই কলম্বোর আকাশটা ভার। মেঘলা আকাশ দেখে মনে হচ্ছিল, অঝর বর্ষণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। বেলা দুইটার দিকে তো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিই নামল। তখনই সংশয় জেগেছে, প্রেমাদাসায় আজ বাংলাদেশ–শ্রীলঙ্কা ম্যাচটা হবে তো?
শেষ পর্যন্ত সংশয় কাটিয়ে টস হলো। ভেজা কন্ডিশন বলেই হয়তো টস জিতে বোলিং বেছে নিলেন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। যদিও তাঁর সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করতে পারেনি বাংলাদেশের বোলাররা। ৬ উইকেটে শ্রীলঙ্কা তুলেছে ২১৪ রান। এত রান তাড়া করে টি-টোয়েন্টিতে জেতার রেকর্ড নেই বাংলাদেশের। ১৬৪ রানের বেশি লক্ষ্য কখনো সফলভাবে পেরোতে পারেনি বাংলাদেশ।
নিদাহাস ট্রফিতে শুরুটা ভালো হয়নি বাংলাদেশের। সিরিজের প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে ৬ উইকেটে হেরে যায় টাইগাররা। ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাঠে নামবে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বাহিনী। ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।
বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য দুঃসংবাদ হয়ে দুপুর আড়াইটায় কলম্বোয় বৃষ্টি শুরু হয়। আবহাওয়া রিপোর্টে আগে থেকে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা ছিল না। বলা যায়, আচমকাই বৃষ্টি নেমেছে।
তবে বিকেল ৪টার খবর, বৃষ্টি থেমে গেছে। যদিও আকাশে ঘনকালো মেঘ রয়েছে। বজ্রপাতও হচ্ছে থেমে থেমে। বাতাসের গতিবেগ স্বাভাবিক। ১১-১২ কিলোমিটার। আবহাওয়ার পরিস্থিতি বলছে ৫টার দিকেও বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সন্ধ্যা ৭টার দিকে মেঘ থাকলেও বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। সে হিসেবে, খেলা যথা সময়েই মাঠে গড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রথম ম্যাচে ভারতের সামনে ১৪০ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দিয়ে বোলাররা কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেনি। রুবেল, মোস্তাফিজ আর তাসকিন মিলে ৪টি উইকেটের পতন ঘটাতে পারলেও সহেজেই জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ভারত। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই শ্রীলঙ্কার কাছে হেরেছিল ভারত। সেই শ্রীলঙ্কারই মুখোমুখি হওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের।
ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় (ওয়ানডে ফরম্যাটে) সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে হারের পর টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজেও বিধ্বস্ত হয়েছে টাইগাররা। এবার লঙ্কানদের ঘরের মাঠেই তাদের বিপক্ষে খেলতে নামছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল। নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর মিশনে কতটা সফল হয় টাইগাররা, সেটাই দেখার বিষয়।
কত দিন পর কথাটা শুনতে হচ্ছে বাংলাদেশকে…
প্রেমাদাসার জিমনেশিয়ামের সরু গলিটা ধরে কোথায় যেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। দেখা হতেই ‘কী খবর?’ বলেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। হাথুরুর কাছে কিছু প্রশ্ন ছিল, সেটা করার আর সুযোগ হলো না।
কাল দলের প্রতিনিধি হয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন রমেশ রত্নায়েকে। তাঁর কথায় থাকল ‘বাংলাদেশকে হালকাভাবে নিচ্ছি না’ ধরনের ক্রিকেটীয় সৌজন্য। কত দিন পর বাংলাদেশকে শুনতে হচ্ছে এসব কথা। অথচ গত বছর শ্রীলঙ্কা সফরে এই ‘সৌজন্য’ দেখিয়েছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মাটিতেই বাংলাদেশকে টানা তিনটা সিরিজ হারিয়ে এসেছে শ্রীলঙ্কা। এবার নিজেদের দেশের মাঠে মাহমুদউল্লাহদের আরও এলোমেলো করে দেওয়ার সুযোগটা কীভাবে কাজে লাগাতে চায় শ্রীলঙ্কা? রত্নায়েকে অবশ্য বিষয়টা দেখছেন অন্যভাবে, ‘আপনারা এভাবে দেখছেন। আপনারা দেখছেন, তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তবে আমি মনে করি, আমরা সেখানে (বাংলাদেশে) ভালো খেলেছি।
হয়তো তারা একটু খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা প্রতিটি ম্যাচই গুরুত্বের সঙ্গে নিই। আমি নিশ্চিত তাদের চাওয়া একই, আমাদের দেখাতে চায় তারা আলাদা। আমরা এটার জন্য ভালোভাবে তৈরি।’
ধারাবাহিক ব্যর্থতায় বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসের পারদ ক্রমেই নিম্নমুখী। এ অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তারা? ক্রিকেটীয় সৌজন্য বলে কিছু আছে বলে প্রতিপক্ষের একজন কোচ হিসেবে সরাসরি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিতে পারেন না রত্নায়েকে। তবে যেটি বললেন, সেটি শুনে অনুপ্রেরণা খুঁজে নিতে পারে বাংলাদেশ, ‘তারা অনেক শক্তিশালী দল। দেশের মাঠে তারা সব দলকেই হারিয়েছে। তারা আমাদের মাঠেই আমাদের হারিয়েছে। এ দলে কিছু খেলোয়াড় আছে, যাদের দুর্দান্ত কিছু করার সামর্থ্য আছে। তবে আমরা তাদের বিপক্ষে খেলতে তৈরি।’
কুমার সাঙ্গাকারা-মাহেলা জয়াবর্ধনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর শ্রীলঙ্কাকে কিছুদিন কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। কিন্তু হাথুরুর ছোঁয়ায় কীভাবে যেন সেই শ্রীলঙ্কাই বদলে গেছে। হাথুরুর কাছে কি জাদু আছে? শ্রীলঙ্কার বোলিং কোচ রত্নায়েকে বললেন আসল কথাটা, ‘সব সময়ই বলে এসেছি, আমাদের দলে অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে।
দরকার শুধু ভাবনায় পরিবর্তন। হাথুরু এসে সেটাই করেছে। তাদের ভাবনাটা বদলে দিয়েছে সে। খেলোয়াড়দের স্মার্ট অপশন বেছে নিতে উৎসাহিত করে সে। যদি ব্যর্থও হয় কেউ, তবুও বলে, “যথেষ্ট ভালো ছিল। পরে আবারও চেষ্টা কোরো।” ধরুন, আপনি একটা ছেলেকে বলছেন শট খেলতে। যদি সে আউট হয়ে যায়, আপনি প্রশ্ন করতে পারেন না, “তুমি কেন এই শট খেলেছ?” সে এক কথার মানুষ। আমরা খেলোয়াড়দের এই আত্মবিশ্বাসটা দিয়েছি।’
বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের ঘাটতিটা বোধ হয় এখানেই—আত্মবিশ্বাসের অভাব!
নতুন শ্রীলঙ্কা, অচেনা বাংলাদেশ
সময়ের হিসাবে ব্যবধানটা মাস দুয়েকের। কিন্তু পরিস্থিতি বিচারে মেরু ব্যবধান।
জানুয়ারিতে যখন ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে এল শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ উড়ছে। ত্রিদেশীয় সিরিজে জিম্বাবুয়ে-শ্রীলঙ্কাকে হটিয়ে ট্রফিটা জেতা নিয়ে শঙ্কা তেমন ছিলই না, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতেও জয়ের আশাটাও ছিল উঁচু তারে বাঁধা। বছর দুয়েক ধরে শ্রীলঙ্কা কেবলই নিচে নামছিল, বাংলাদেশ সে সময়ে উড়ছিল।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে মার্চে চলে আসুন। ঢাকা থেকে আসুন কলম্বোয়। শ্রীলঙ্কা এখন উড়ছে, আর বাংলাদেশ দল নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে। মাঝে ত্রিদেশীয় সিরিজ, টেস্ট, টি-টোয়েন্টি—সবই জিতে নিয়ে গেছে লঙ্কানরা। বাংলাদেশ পড়ে গেছে হারের ঘূর্ণাবর্তে। এদিক-ওদিক অনেক হাতড়েও একটা জয় মিলছে না।
আত্মবিশ্বাসে ১৮০ ডিগ্রি ফারাক নিয়েই আজ প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে টস করতে নামবেন দুই অধিনায়ক দিনেশ চান্ডিমাল ও মাহমুদউল্লাহ।
লঙ্কানদের অবশ্য এতে বিশ্বাস নেই। থাকলেও অন্তত মুখে সেটি বলছে না। ম্যাচের আগে যে প্রতিপক্ষকে অসম্মান করতে নেই! শ্রীলঙ্কান দলের পেস বোলিং কোচ রুমেশ রত্নায়েকেও সৌজন্যবোধ মেনেই চললেন। কাল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের দুরবস্থার প্রসঙ্গ উঠতেই ভদ্রলোক ‘ও রকম আপনাদের মনে হচ্ছে’ বলে এড়িয়ে গেলেন।
বরং তুলনা দিলেন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের গত বছর দুয়েকের বাজে সময়ের সঙ্গে, ‘ওদের হয়তো একটু খারাপ সময় যাচ্ছে, যেমনটা আমাদের গেছে এর আগের দুই বছর। তবে আমরা এই ম্যাচটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গেই নিচ্ছি। কারণ আমি নিশ্চিত ওরা দেখিয়ে দিতে চাইবে, (সর্বশেষ সিরিজের পর) ওরা যে বদলেছে, সেটি বোঝাতে চাইবে।’
তা বাংলাদেশ যে চায়, সেটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সমস্যা হচ্ছে, চাওয়া আর পাওয়ায় মিলছে না। ভারতের সঙ্গে প্রথম ম্যাচে মেলেনি। মিলবে কী, প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেনি বাংলাদেশ। আজও জয় না এলে? এরপরও দুটি ম্যাচ বাকি থাকবে বাংলাদেশের। তবে ১৮ তারিখ নিদাহাস ট্রফির ফাইনালটা ‘ভারত বনাম শ্রীলঙ্কা’ হওয়া ঠেকানো তখন কঠিনই হয়ে পড়বে।
বালাই ষাট! অমন চিন্তা করতেও রাজি নয় বাংলাদেশ। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে এসে তাসকিন আহমেদ তো গ্রুপ পর্বে বাকি তিন ম্যাচের সব কটিতেই জয়ের আশা দেখিয়ে গেলেন, ‘এখনো তিনটা ম্যাচ আছে। তিনটার মধ্যে দুটিতে ভালো রানরেট নিয়ে জিতলে আশা করি ফাইনালে যাওয়া যাবে, তিনটা জিতলে তো কথাই নেই।’
আশা দেখাচ্ছেন, তবে আশার বেলুনটাকে ফোলাচ্ছেনও না তাসকিন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাটিতেই যেখানে সর্বশেষ দুটি টি-টোয়েন্টিতে হার জুটেছে কপালে, সেখানে এবার তাদেরই মাটিতে ম্যাচ। লঙ্কানরা আছেও আগুনে ফর্মে। তাসকিনও তাই বাস্তবের মাটিতেই পা রাখছেন, ‘ওদের মাটিতে ওদের সঙ্গে খেলা, চ্যালেঞ্জটা সহজ হবে না। প্রথম ম্যাচটা ভারতের সঙ্গে জেতায় ওদের আত্মবিশ্বাসও তুঙ্গে। তবে আমাদেরও মানসিকভাবে শক্ত থেকে ওদের সঙ্গে লড়ে যেতে হবে।’ লড়াইয়ের ‘শর্ত’টাও জানিয়ে দিলেন, ‘আমাদের ব্যাটিং-বোলিং দুই দিক থেকেই আরও ভালো অবদান রাখা লাগবে।’
ক্রিকেটে কোন ম্যাচে সেটা লাগে না? তবু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কথাটা আলাদা করে বলে দিতে হয়। টি-টোয়েন্টিতে সর্বশেষ কয়েকটি ম্যাচের স্মৃতিই বলতে বাধ্য করে। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং, শেষ কবে সব ক্ষেত্রেই একসঙ্গে ভালো করেছে বাংলাদেশ দল? করেনি বলেই…এই যাহ্, সর্বশেষ ১৪ ম্যাচে ১৩ হারের কথাটা বলতে না চাইলেও এসেই পড়ে বারবার!
শ্রীলঙ্কা বলেই সর্বশেষ সিরিজের কথাটাও আসে। সেবার দুই ম্যাচেই ‘উদার’ বোলিং করেছে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে ব্যাটসম্যানদের ১৯৩ রানের স্কোরটাও আগলে রাখা যায়নি, দ্বিতীয় ম্যাচে তো আগে ব্যাটিং পেয়ে শ্রীলঙ্কা করে ফেলে ২১০। নিদাহাস ট্রফির প্রথম ম্যাচে আবার ব্যাটসম্যানরা দেখিয়েছেন ‘সৌজন্যবোধ’। নিজেরা রান নিয়ে কষ্ট দেননি ভারতীয় বোলারদের। ১৩৯ তো এ যুগের টি-টোয়েন্টিতে রানই নয়!
তা আজ বুক ফুলিয়ে বলার মতো রানটা কত হতে পারে? তাসকিন ‘১৭০-১৮০’-তেই চোখ রাখছেন। কিন্তু এখানেও আবার শঙ্কা! ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কুশল পেরেরা যেমন ব্যাটিং করলেন, তারপর শঙ্কাটা না এসেই পারে না। থিসারা পেরেরা, কুশল মেন্ডিসরা তো আছেনই!
তাই বলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়াটা সম্ভবত ঠিক হবে না। রুমেশ রত্নায়েকের মন্তব্যকেও তাই গুরুত্ব দিতে হয়, ‘বাংলাদেশ কিন্তু শক্ত দল। নিজেদের মাটিতে সবাইকে হারিয়েছে। আমাদের এখানে এসে আমাদের হারিয়েছে। বড় বড় কিছু নাম আছে ওদের দলে, দুর্দান্ত কিছু করার প্রতিভাও আছে।’
আরেকটা ব্যাপার আছে। প্রেমাদাসাও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচের স্মৃতি। মাশরাফির টি-টোয়েন্টি থেকে বিদায়ের সেই ম্যাচটা জয় দিয়েই রাঙিয়েছিল বাংলাদেশ।
স্মৃতিটা তাজা হবে আজ? তাতে যে দলটাও একটু আড়মোড়া ভেঙে উঠতে পারে। ফিরতে পারে চেনা ছন্দে।