২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে যাবেন। তাকে বিদায় জানাতে গণভবনে এসেছেন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষস্থানীয় নেতারা। শেখ হাসিনা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠবেন এমন সময় যুবলীগের নেতৃবৃন্দকে সামনে পেলেন, শেখ হাসিনা ঘুরে দাড়ালেন এবং তাদেরকে বললেন, যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছ থেকে চাঁদা চেয়েছে।
শেখ হাসিনা বললেন, আমি রেহানা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামকে অনুদান দেই আর সেখানে সম্রাট চাঁদাবাজি করে! এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করো, না হলে কিন্তু পরিস্থিতি ভালো হবে না। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতা সম্রাটকে সমর্থন করে প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, সম্রাট এরকম নয়। কিন্তু শেখ হাসিনা আরো কঠোর ভাষায় বললেন, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, না হয় এদেরকে শাস্তি দিতে হবে।
একবছর পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ ঢাকা দক্ষিণে যারা চাঁদাবাজি, দুর্বৃত্তায়ণ এবং ক্যাসিনো বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে অ্যকশন শুরু করেন। সেই অ্যাকশনে যুবলীগের সম্রাট, খালেদসহ একাধিক ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং ক্যাসিনো বাণিজ্যের মূলোৎপাটন করা হয়েছে।
২০১৮ সালে শেখ হাসিনা যে বার্তা দিয়েছিলেন, তা বুঝতে পারেনি যুবলীগ নেতৃবৃন্দ। সেই সময় যদি সম্রাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো, তাহলে একদিকে যেমন পরিস্থিতি এরকম হতো না, অন্যদিকে যুবলীগের ওই নেতৃবৃন্দও তাদের পদ এবং মর্যাদা হারাতেন না। কাজেই আওয়ামী লীগ সভাপতি কি সংকেত দেন, কি ইঙ্গিত দেন তা বোঝা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দর জন্য অনেক জরুরি।
বিশেষ করে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা, দুরদৃষ্টিতা এবং বিচক্ষণতায় অনেক উপরে চলে গেছেন। আওয়ামী লীগের চেয়ে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা এখন অনেক বেশি। সে কারণেই তাঁর প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি বক্তব্য সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী এবং সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা সম্পন্ন। তাই প্রশ্ন উঠে যে, শেখ হাসিনা যে বার্তাগুলো দেন তা কি দলের নেতারা বুঝতে পারেন?
সাম্প্রতিক সময় শেখ হাসিনা দুটি বিষয়ে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে;
অপারেশন ফরিদপুর
গত কিছুদিন ধরে ফরিদপুরে শুদ্ধি অভিযান চলছে। সেখানকার প্রভাবশালী নেতা হিসাবে যারা পরিচিত ছিলো, তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তারা হাজার হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করে বিদেশে পাঠিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। একসময় ফরিদপুরে যাদের কথাই শেষ কথা হিসাবে বিবেচিত ছিলো, এখন তারা আইনের আওতায় এসেছেন।
এই ঘটনাটি যদি কেউ শুধুমাত্র ফরিদপুরের ঘটনা হিসাবে বিবেচিত করেন তাহলে তারা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শণ এবং বিচক্ষণতাকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এই ঘটনার একটি সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে। শেখ হাসিনা মূলত এর মাধ্যমে সারাদেশের আওয়ামী লীগের জন্য বার্তা দিয়েছেন। বার্তাটি খুব সুস্পষ্ট এবং পরিস্কার। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকলেই যে অপকর্ম করে পাড় পাওয়া যাবে এরকম ধারণা ভেঙ্গে দিলেন শেখ হাসিনা।
তিনি জানিয়ে দিলেন যে, যত বড় প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় থাকুক না কেন অপরাধ করলে তার শাস্তি পেতে হবে। এর মাধ্যমে সারাদেশের অন্যান্য জেলাগুলোতেও যে সমস্ত প্রভাবশালী নেতারা তাদের ছত্রছায়ায় দুর্বৃত্তদের লালন পালন করেন, দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করেন, তারা যদি শিক্ষা না নেন তাহলে ভবিষ্যতের জন্য এক খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। সামনে এই ফরিদপুরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে অনেক জেলাতেই, বিশেষ করে যে জেলাগুলোতে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এ ধরণের দুর্বৃত্তদের পোষণ বা লালন করেন এবং তাদের ক্ষমতাবান করেন।
পাবনা-৪ আসনের উপনির্বাচন
এই উপনির্বাচনে শেখ হাসিনা পাবনা-৪ আসনের মনোনয়ন নিয়ে একটা চমক সৃষ্টি করেছেন। প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে পাবনা-৪ আসনের রাজনীতি মানেই ছিলো ডিলু পরিবারের রাজনীতি। এই পরিবারের বাইরের কেউ মনোনয়ন পেতেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা এবার সেই ডিলু পরিবারের রাজত্ব ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়ে নুরুজ্জামান বিশ্বাসের মতো ত্যাগী পরীক্ষিত ব্যক্তিকে মনোয়ন দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি দুটি বার্তা দিয়েছেন, প্রথমত কোন এলাকা কারো নিজস্ব তালুক বা জমিদারি নয়। আওয়ামী লীগ জনগনের দল, জনগনের উপর রাজত্ব কায়েম করে কোন পরিবার যদি কোন এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে তাদের পরিণাম এরকমই হবে। দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে তিনি দলের তৃণমূলকে এখন সামনে আনতে চান। দলের তৃণমূলে যারা ত্যাগী পরীক্ষিত তাদের যোগ্য আসনে আসীন করাতে চান। নুরুজ্জামান বিশ্বাস তার একটি বড় উদাহরণ।
আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার এই বার্তাগুলো বুঝতে পেরেছেন কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। কারণ এই বার্তা যদি তারা বুঝতে না পারেন, ভবিষ্যতে তাদেরও হয়তো তাহলে অনেক হোঁচট খেতে হতে পারে রাজনীতিতে।
বাংলা ইনসাইডার