জাফর ইকবালের ওপর হামলা, আ.লীগ নেতা আটক

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর রহমানের শেখপাড়ার বাসায় তল্লাশি চালিয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সেখান থেকে তাঁর মামা সুনামগঞ্জ জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম আহবায়ক ফজলুর রহমানকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া একটি ল্যাপটপও জব্দ করা হয়েছে বলে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে জানান।

ওসি শফিকুর রহমান জানান, শনিবার রাত ১২টা নাগাদ শাবিপ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের ওই বাসাটিতে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। সে সময় বাসাটি বাইরে থেকে তালা লাগানো থাকায় পুলিশ তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তালাবদ্ধ বাসার ভেতরে ফয়জুরের মামা ফজলুর রহমান অবস্থান করছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাত সোয়া ১ টার দিকে থানায় নিয়ে আসা হয়।

এ দিকে অধ্যাপক জাফর ইকবাল শঙ্কামুক্ত আছেন বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সূত্রে জানা গেছে। আজ তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর সকাল ১১ টায় গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানানো হবে। শনিবার রাতে আইএসপিআর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাশেদুল হাসান প্রথম আলোকে মুঠোফোনে এই তথ্য নিশ্চিত করেন।

এর আগে শনিবার বিকালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান চলাকালে অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল হামলার শিকার হন। তাঁর পেছনে থাকা ফয়জুর রহমান ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁকে আঘাত করেন। উন্নত চিকিত্সার জন্য ড. জাফর ইকবালকে ঢাকার সিএমএইচে আনা হয়। ৫ সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের অধীনে তাঁর চিকিত্সা চলছে।

কে এই হামলাকারী?

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীর নাম ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল (২৪)।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ার বাসিন্দা ফয়জুর রহমান। তাঁর মূল বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই। ঘটনার পরপরই শেখপাড়ার বাসাটি তালাবদ্ধ করে ফয়জুলের পরিবারের সদস্যরা চলে গেছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে হামলাকারীর এই পরিচয় পাওয়া গেছে। শনিবার সন্ধ্যায় শেখপাড়ার বাসাটিতে গিয়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের বাসাটি তালাবদ্ধ। কুমারগাঁও বাসস্টেশনের দুজন প্রত্যক্ষদর্শী ফয়জুলের পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে চলে যেতে দেখেছেন। তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘মেডিকেলে যাচ্ছি।’

এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ফয়জুল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বলে এলাকায় পরিচয় দিতেন। তবে কোন মাদ্রাসায় পড়েন-এ বিষয়ে এলাকার কেউ জানাতে পারেননি। ফয়জুলের বাবা আতিকুর রহমান সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পার্শ্ববর্তী টুকেরবাজারে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। রাত নয়টার দিকে আতিকুরের মোবাইলে ফোন দিলে ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরেননি। এরপর ফোন দিলে মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।

হামলায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখছে সিটিটিসি

বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। হামলার ধরন দেখে প্রাথমিকভাবে জঙ্গি হামলা হতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এজন্য সিটিটিসি’র একটি টিম সিলেট গিয়ে আটক হামলাকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই জাফর ইকবাল জঙ্গিদের লক্ষ্যে (টার্গেটেড) ছিলেন। বিশেষ করে আল কায়েদার অনুসারী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে তাকে হামলার জন্য অনুসরণ করেছে।

সিটিটিসির উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘এই হামলার সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা, তা এখনও আমরা নিশ্চিত নই। এরই মধ্যে আমাদের একাধিক টিম কাজ শুরু করেছে। হামলাকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে বিষয়টি পরিষ্কার  (ক্লিয়ার) হবে।’

সিটিটিসি সূত্র বলছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আনসার আল ইসলামের একটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে শাবিপ্রবি’র একাধিক শিক্ষার্থীকে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারও করা হয়েছে। হামলার ধরনেও মনে হচ্ছে, এ ঘটনার সঙ্গে আনসার আল ইসলাম জড়িত থাকতে পারে।

সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আনসার আল ইসলামের সদস্যরা হামলার সময় মাথায় আঘাত করে বেশি। এটা তাদের কৌশল। আনসার আল ইসলামের আসকারি বিভাগের সদস্যদের হামলার ধরন নিয়ে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। আসকারি বিভাগের সদস্যরা সরাসরি হামলায় অংশ নিয়ে থাকে।’
সম্প্রতি আলাপচারিতায় সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া আনসার আল ইসলামের সদস্যদের কাছ থেকে এমন কিছু নথিপত্র তারা উদ্ধার করেছেন, যাতে অন্তত ৪০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, লেখক, ব্লগার তথা জঙ্গিদের ভাষায় ‘ইসলামবিরোধী’দের নাম রয়েছে।

আনসার আল ইসলামের সদস্যরা তাদের নিয়মিত অনুসরণ করতো। তারা কখন কোথায় যান এবং কোথায় থাকেন, তার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে। ওই তালিকায় জাফর ইকবালের নামও ছিল বলে জানিয়েছিলেন ওই কর্মকর্তা।

সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, নব্য জেএমবি’র সদস্যদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও আনসার আল ইসলাম ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। নিষিদ্ধ এই সংগঠনের সামরিক কমান্ডার বা সমন্বয়ক সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়াকে না ধরা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জাফর ইকবালের হামলার ঘটনায় অন্তত তিন জন অংশ নিয়েছিল বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। হামলার আগে পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়। এর ফাঁকেই হামলাকারী জাফর ইকবালের মাথায় চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। আনসার আল ইসলামের সদস্যরা জনারণ্যের মধ্যে এরকম হামলাতেও প্রশিক্ষিত। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লোকসমাগমের মধ্যেই লেখক ব্লগার অভিজিত রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে।

সিটিটিসির আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, “আনসার আল ইসলামের সদস্যরা সবসময়ই ছুরি বা চাপাতি দিয়ে হামলা করে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হামলায় তাদের নজির নেই। ছুরি বা চাপাতি দিয়ে হামলাকে তারা ‘কতল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।”

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘জাফর ইকবালের ওপর হামলার ধরনের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের হামলার মিল থাকলেও এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। শিগগিরই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।’

উল্লেখ্য, শনিবার বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান চলাকালে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে পেছন থেকে মাথায় ছুরিকাঘাত করে ২৪-২৫ বছর বয়সী এক তরুণ। এরপর তাকে সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরই মধ্যে সেখানে অস্ত্রোপচার শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়েছে। এর আগে, তার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. দেবপদ রায়।

ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকেও নিন্দা জানানো হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন ‘এ’-এর সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ-মিছিল করেছেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগেও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে গণজাগরণ মঞ্চ।

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin