জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় কারাভ্যন্তরে স্থাপিত বিশেষ আদালতে বারবার উপস্থিত হতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাঁর এই বক্তব্যের পর প্রশ্ন উঠেছে, পরবর্তী সময়ে তিনি যদি আদালতে উপস্থিত না হন তবে এ মামলায় বিচারকাজ চলবে কি না?
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি নির্ভর করছে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর। একদিকে উচ্চ আদালত, আরেক দিকে বিশেষ জজ আদালতের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার ভবিষ্যৎ বিচার কার্যক্রম।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যদি আদালতে হাজির না হন তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচারকাজ চলতে বাধা থাকবে না। সে ক্ষেত্রে আদালত খালেদা জিয়াকে অনুপস্থিত দেখিয়ে বিচারকাজ পরিচালনা করবেন। এ জন্য আইনে আদালতকে ক্ষমতা দেওয়া আছে।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, খালেদা জিয়া যদি আর আদালতে হাজির না হন তবে তাঁর বিচার চলবে কি না সেটা নির্ভর করছে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর। জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় বিশেষ জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (দুদকের আইনজীবী) মোশাররফ হোসেন কাজল কালের কণ্ঠকে বলেন, খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী।
আশা করি তিনি আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আদালতে হাজির হয়ে পরবর্তী বিচার কার্যক্রমে অংশ নেবেন। আর তিনি যদি আদালতে হাজির না হন তাহলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আইন অনুযায়ী তাঁকে আদালতে হাজির করার জন্য আবেদন জানানো হবে। অন্যথায় তাঁর অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ পরিচালনার আবেদন জানানো হবে। তিনি বলেন, প্রসিকিউশন ও আদালত খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল।
এ কারণেই আদালত বারবার তাঁর জামিন বর্ধিত করেছেন। সর্বশেষ ৫ সেপ্টেম্বর আদালতে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা না থাকায় তাঁর জামিন বর্ধিত করার জন্য প্রসিকিউশন থেকেই আদালতে মৌখিকভাবে আবেদন করা হয়। আদালত সেটাকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখেছেন।
তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও আমিনুল ইসলাম পৃথকভাবে কালের কণ্ঠকে বলেন, বেআইনিভাবে কারাগারের মধ্যে আদালত বসানো হয়েছে খালেদা জিয়াকে বেআইনিভাবে সাজা দেওয়ার জন্য। এই আদালত গঠন বেআইনি। তাই যদি বিচারকাজ অব্যাহত রাখা হয় তবে তা চ্যালেঞ্জ করা হবে উচ্চ আদালতে। তাঁরা বলছেন, আইন অনুযায়ী আদালত হতে হবে প্রকাশ্য, যেখানে অবাধে সাধারণ জনগণের যাওয়ার সুযোগ থাকবে।
অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫২ ধারা অনুযায়ী প্রকাশ্য আদালত হতে হবে। আর ৩৫৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী আসামির উপস্থিতি লাগবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে আসামিকে সুস্থ হতে হবে। তাই খালেদা জিয়া উপস্থিত না হলে এ মামলায় বিচারকাজ চলতে পারবে না। তার পরও সরকার যদি বিচারকাজ চালায় তবে সেটা হবে বেআইনি।’
বিএনপির আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে বলা হয়, ঢাকার পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের যে ৭ নম্বর কক্ষটিকে আদালত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে তা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৩) নম্বর অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫২ নম্বর ধারা পরিপন্থী। আইন অনুযায়ী এটা উন্মুক্ত আদালত না হওয়ায় এবং সেখানে পাবলিক ট্রায়াল হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় এই আদালতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম চলার আইনগত কোনো সুযোগ নেই।
জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াসহ অপরাপর আসামিদের বিচার করার জন্য নাজিমুদ্দীন রোডের পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষকে আদালত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ জন্য গত ৪ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সে অনুযায়ী পরদিন সেখানে আদালত বসে। সেখানে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা না গেলেও খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দি অন্য আসামিদের হাজির করা হয়। কিন্তু কারাগারের ভেতরে আদালত বসানোর বিষয়ে প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার চেয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন। লিগ্যাল নোটিশে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গেজেট প্রত্যাহার চাওয়া হয়। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকার কারাগারের মধ্যেই বিচারকাজ অব্যাহত রাখলে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হবে। আদালত গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হবে। এটা হলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে কারাভ্যন্তরে স্থাপিত আদালতে খালেদা জিয়ার বিচার চলবে কি না? এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার (জেল হত্যা মামলা) বিচার হয়েছে নাজিমুউদ্দীন রোডের কারাগারসংলগ্ন ভবনে। তাই এখানে খালেদা জিয়ার বিচার চলতে আইনগত কোনো বাধা নেই। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও জেল হত্যা মামলার বিচার হয়েছে কারাগারের বাইরে একটি ভবনে। আর খালেদা জিয়ার বিচার করা হচ্ছে কারাগারের ভেতরে একটি কক্ষে। আইন অনুযায়ী এটা উন্মুক্ত আদালত নয়। সেখানে প্রবেশ করতে হলে কারা কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। এ কারণেই এটা বেআইনি আদালত।
আইনজীবীরা বলছেন, খালেদা জিয়া নিজে থেকে অনুপস্থিত থাকলে আদালত কারা কর্তৃপক্ষের ওপর আদেশ দিতে পারবেন আসামিকে আদালতে হাজির করার জন্য। কারণ এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ তিন আসামি কারাবন্দি। সে ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষ কী প্রতিবেদন দেয় সেটার ওপর নির্ভর করবে আদালতের পরবর্তী সিদ্ধান্ত কী হবে? কারা কর্তৃপক্ষ যদি সন্তোষজনক প্রতিবেদন দিতে না পারে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ খালেদা জিয়াকে অনুপস্থিত দেখিয়ে বিচারকাজ পরিচালনার আবেদন জানাতে পারে। এ ছাড়া এ মামলায় খালেদা জিয়া জামিনে থাকায় সে বিষয়টিও আদালত বিবেচনায় নিতে পারেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিশেষ জজ আদালত বিচারকাজ পরিচালনার জন্য যে আদেশ দেবেন সে আদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের উচ্চ আদালতে আবেদন করার সুযোগ থাকবে। সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন পড়বে। সব মিলে এ মামলায় পরবর্তী কার্যক্রম কী হবে তা নির্ভর করছে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর।