স্বাগতম মাহে রমজান

স্বাগতম মাহে রমজান

ইসলাম ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দর্শন ও মতবাদের প্রতি দৃষ্টি দিলে উপলব্ধি করা যাবে, সবগুলো মতবাদই কেবল মানব মস্তিষ্ককে সম্বোধন করে কথা বলেছে। আর অন্যান্য ধর্ম ও অধ্যাত্মবাদ কথা বলেছে শুধু মানব হূদয়কে সম্বোধন করে। মস্তিষ্ক ও হূদয় উভয়ের রাজ্য পৃথক পৃথক। যেখানে তারা কোনোরূপ অংশীদারিত্ব ছাড়া একচ্ছত্র আধিপত্য চালনা করে থাকে। এ দু বাদশাহ এক রাজ্যে অবস্থান করতে পারে না। শুধু তাই নয়; বরং অনেক সময় তাদের পরস্পরের প্রতি মারমুখী দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু ইসলাম একই সাথে মানব-হূদয় ও মানব-মস্তিষ্ক উভয়কে সম্বোধন করে কথা বলে থাকে।

ফলে তাদের মধ্যে এমন কোনো রেষারেষী হওয়ার সুযোগ থাকে না, যা তাদের পরস্পরের প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করাবে; বরং প্রাথমিক পর্যায়ে উভয়ে নিজ নিজ সীমা নির্ধারণ করে সহাবস্থান করতে থাকে। পরিশেষে একে অপরের সাথে দুধ-চিনির মতো মিশে এমনভাবে একাকার হয়ে যায়, যেমন দুটি নদীর মোহনা এক পর্যায়ে একদেহ একপ্রাণ হয়ে পড়ে। এ সন্ধিক্ষণেই হূদয় ‘প্রেম-প্রীতির’ সাথে সাথে ‘বুদ্ধি-বিবেচনা’ খাটাতে পারে, আবার মস্তিষ্কে ‘বুদ্ধি-বিবেচনা’র সঙ্গে সঙ্গে ‘প্রেম-প্রীতি’র যোগ্যতাও জন্ম নেয়।

এ সূক্ষ্ম বাস্তবতার ভাষায় প্রকাশ করার চেয়ে অধিক উপলব্ধি করার বিষয়—মানুষ যদি পবিত্র কোরআনের ওই সমস্ত আয়াত নিয়ে গবেষণা করে, যে সমস্ত আয়াতে ‘বুদ্ধি-বিবেচনা’কে মস্তিষ্কের পরিবর্তে হূদয়ের বিশেষণ সাব্যস্ত করা হয়েছে, তাহলে আল্লাহর কালামের এ অলৌকিকতার সম্মুখে সাহিত্যালঙ্কারের সমগ্র জগতকে সেজদাবনত দেখতে পাওয়া যাবে।

সারকথা হলো, ইসলামী শিক্ষায় বুদ্ধি ও প্রেমের এমন অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে, এতদুভয়ের কোনো একটিকেও যদি পৃথক করা হয়, তাহলে এর সব সৌন্দর্যই নষ্ট হয়ে যাবে। আকিদা ও ইবাদতের ব্যবস্থাপনা যদি বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে যায়, তাহলে অলীক বস্তু পূজা ও দেব-দেবীর উপাসনার ধর্ম অস্তিত্ব লাভ করে।

পক্ষান্তরে বুদ্ধিকে আকিদা ও ইবাদত থেকে মুক্ত করা হলে তা এমন শুষ্ক ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন জন্ম দিয়ে থাকে, যা বস্তুবাদের ওপারে দৃষ্টি দেওয়ার যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলে। উভয় অবস্থায় ফলাফল দাঁড়ায় চির বঞ্চনা। কোথাও দেহের বৈধ চাহিদা থেকে বঞ্চিত হতে হয়, আর কোথাও বঞ্চিত হতে হয় হূদয়ের প্রকৃত আবেদন থেকে।

ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রয়োজনে যখন থেকে ইসলামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শিক্ষার ওপর এ যুগের চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও কলামিস্টগণ অধিক জোর দিতে আরম্ভ করেছেন, তখন থেকে কেউ কেউ চেতনভাবে বা অবচেতনভাবে আকিদা ও ইবাদতকে পশ্চাতে ফেলে দিয়ে এর প্রতি যথার্থ গুরুত্ব প্রদান পরিত্যাগ করেছেন। ফলে মানুষ ‘অর্থনৈতিক জীবে’ পরিণত হয়েছে।

মানুষের যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা সে দেহ প্রতিপালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছে, যা একদিন না একদিন মাটিতে মিশে যাবে। আধ্যাত্মিক উন্নতির ওই সমস্ত সোপানে আরোহণের কোনো চিন্তা তাদের নেই, যা প্রকৃতপক্ষে মানুুষকে অন্যান্য পশু থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে এবং যা লাভ করার ফলে মানুষ মাটিতে বিলীন হয়েও অমর হয়ে থাকে।

যারা বৈষয়িক উন্নতি ও প্রবৃত্তির ভোগকেই নিজেদের সর্বোচ্চ স্বপ্ন মনে করে, তাদের আভ্যন্তরীণ জীবনের প্রতি উঁকি দিয়ে দেখুন, তারা আরাম ও বিলাসিতার যাবতীয় উপায়-উপকরণ লাভ করা সত্ত্বেও ‘আত্মার শান্তি’ থেকে কত বেশি বঞ্চিত। কারণ, তারা নিজেদের চতুপার্শ্বে যে জগত খাড়া করেছে, তা বিশ্বের সমস্ত ধনভাণ্ডার এনে তাদের পদপ্রান্তে স্তূপ করতে সক্ষম হলেও আত্মার শান্তি ও অন্তরের স্থিরতা প্রদান করতে সক্ষম নয়।

এটা আল্লাহ সম্পর্কে অপরিচিত জীবনের অবশ্যম্ভাবী বৈশিষ্ট্য। এর অনুরাগীরা এক অজানা অস্থিরতার শিকার হয়ে থাকে। এ অস্থিরতার বেদনাদায়ক একটি দিক হলো, তাদের এ কথাও জানা থাকে না, কী কারণে তারা এমন অস্থির। তারা সর্বদাই হূদয়ে এক অজানা অশান্তি ও রহস্যঘেরা অতৃপ্তি উপলব্ধি করে থাকে, কিন্তু কেন এ অস্থিরতা, কোত্থেকেই বা এর উৎপত্তি, তাও তারা জানে না।

মানুষ বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রভু নয়; বরং সে এক মহান সত্তার সৃষ্টি। মানবজীবনের লক্ষ্যই হলো একজনের দাসত্ব করা। ফলে মানবসত্তার সহজাত আবেদনই হলো, অবিনশ্বর কোনো সত্তার সম্মুখে দাসত্বের মস্তক অবনত করে তৃপ্তি লাভ করা। তার শ্রেষ্ঠত্বের সম্মুখে নিজের তুচ্ছতা ও অপারগতার পুঁজি নিবেদন করা। বিপদে সে মহান সত্তার নামে আশ্রয় গ্রহণ করা। সাহায্যের জন্য একমাত্র তাঁকেই আহ্বান করা। বিপদসংকুল জীবনের জটিলতম মুহূর্তগুলোতে তাঁরই তাওফিকে পথনির্দেশ লাভ করা।

বর্তমানের বস্তুপূজারী জীবন মানুষকে বিশ্বের যাবতীয় সম্পদ এনে দিতে পারলেও তার এ সহজাত প্রবৃত্তি ও আবেদনের পরিতৃপ্তি এনে দিতে পারে না। মানবের এ সহজাত প্রবৃত্তি কোনো কেনো সময় রিপুর তাড়নার স্তূপে হারিয়ে গেলেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। এটিও মানবের সে সুপ্ত সহজাত প্রবৃত্তি, যা তাকে আরাম ও বিলাসিতার, তৃপ্তি ও পুলকের যাবতীয় সরঞ্জাম লাভ করা সত্ত্বেও শান্তি পেতে দেয় না; বরং অনেক সময় তা মানবজীবনকে উজাড় করে ছাড়ে। ‘হে আল্লাহ, তোমাকে হারিয়ে এমন অবাঞ্চিত জীবনযাপন করছি, যেন আমার পুরো জীবনটাই সাক্ষাৎ পাপ।’

ইসলামে ইবাদত শাখাটি এজন্যই রাখা হয়েছে, একে যথাযথভাবে পালন করা হলে ইবাদতের এপন্থা মানবাত্মাকে প্রকৃত জীবিকা দান করে মহান আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক সুদৃঢ় ও অটুট করে দেয়। এটি দেহ ও আত্মার বিপরীতমুখী আবেদনে ভারসাম্য সৃষ্টি করে মনকে এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ বিন্দু পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, যার অপর নাম ‘শান্তি ও পরিতৃপ্তি’। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মনে রেখো, আল্লাহর স্মরণেই হূদয় প্রশান্তি লাভ করে।’

প্রতিবছর পবিত্র রজযান মাস এ জন্যই আগমন করে, বছরের এগারোটি মাস মানুষ তার বৈষয়িক ব্যস্ততায় এত অধিক মনোনিবেশ করে, এ ব্যস্ততাই হয় তার সকল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। ফলে তার অন্তরে আধ্যাত্মিক ক্রিয়া-কর্মের ব্যাপারে উদাসীনতার আবরণ পড়তে থাকে। বছরের অপরাপর দিনগুলোর স্বাভাবিক অবস্থা এই হয়, চব্বিশ ঘণ্টার ব্যস্ততায় নিখাঁদ ইবাদতের অংশ সচরাচর অতি অল্পই হয়ে থাকে। এতে করে মানুষ তার আধ্যাত্মিক পথ চলায় পিছে পড়ে যায়।

রমজান মাসে মানুষ দৈহিক খাদ্যের পরিমাণ কম করে দিয়ে আধ্যাত্মিক খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করবে এবং তার দৈহিক পথ চলার গতি কিছুটা মন্থর করে আধ্যাত্মিক পথ চলার গতি বেগবান করবে। এভাবে পুনরায় একবার উভয়ের মাঝে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে সে বিন্দুতে এসে উপনীত হবে, যা মানবজীবনের সর্ববৃহৎ নিয়ামত। গভীর দৃষ্টিতে দেখা হলে ভারসাম্যের এ বিন্দুতে উপনীত হওয়ার আনন্দকেই ঈদুল ফিতরের উৎসবরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে।

অতএব, পবিত্র রমজান শুধুমাত্র রোজা আর তারাবিহর নামই নয়; বরং এর যথার্থ উপকারিতা লাভ করতে হলে মানুষকে এ মাসে নফল ইবাদতের প্রতিও অধিক মনোযোগ আরোপ করতে হবে এবং ‘কারো হক নষ্ট না করে’ বৈষয়িক ব্যস্ততা থেকে সময় ফারেগ করে অধিক থেকে অধিক নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত এবং যিকির ও তাসবিহের মধ্যে সময় অতিবাহিত করতে হবে।

‘কারো হক নষ্ট না করে’ এজন্যই বলেছি, কেউ কোথাও কর্মে নিযুক্ত থাকলে ডিউটির সময় তার দায়িত্ব ছেড়ে নফল ইবাদতে লিপ্ত হওয়া শরীয়তে জায়েজ নেই। তবে হ্যাঁ, কোনো সময় ডিউটি সংক্রান্ত দায়িত্ব না থাকলে এবং অবসর বসে থাকলে সে ভিন্ন কথা। কিন্তু কারো হক নষ্ট না করেও রমজানে নিজের বৈষয়িক ব্যস্ততা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু কমাতে পারে এবং নিজেকে এমন সব ব্যস্ততা থেকে অবসর করতে পারে, যেগুলো অপ্রয়োজনীয় কিংবা পরবর্তীতেও করা সম্ভব।

এভাবে যে সময়টুকু অবসর করতে পারবে, তা নফল ইবাদত, যিকির ও দোয়ার মধ্যে অতিবাহিত করা কর্তব্য। এতদ্ব্যতীত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রমজান মাসে দিনের বেলায় মানুষ যখন রোজা রেখে পানাহার অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালার দাসত্বের দাবি পূরণার্থে এমন সব বস্তু পরিত্যাগ করে, যেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় তার জন্য হালাল ছিল— তাহলে রোজার চাহিদা পূরণার্থে হালাল কাজ পরিত্যাগ করেও এমন কাজ যথাপূর্ব করতে থাকা, যা সাধারাণ অবস্থাতেও হারাম, কত বড় জুলুমের কথা। অতএব পানাহার পরিত্যাগ করল, কিন্তু মিথ্যা, গীবত, অন্যকে কষ্ট দেওয়া, প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ ইত্যাদি যেসব কাজ সর্বাবস্থায় হারাম, তা পরিত্যাগ করল না, তাহলে এমন রোজা মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতিকে কতটুকু সহযোগী হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

তাই পবিত্র রমজান মাসে চোখ, জিহ্বা, কানসহ দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ্যকে সর্বপ্রকার গোনাহ থেকে মুক্ত করার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা এবং আল্লাহতায়ালার নাফরমানির কাজে একটি কদমও যেন না উঠে সে অভ্যাস নিজের মধ্যে গড়ে তোলা উচিত। রমজান মাসকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘পারস্পরিক সমবেদনার মাস’ আখ্যা দিয়েছেন।

এ মাসে তিনি অধিকহারে দান-খয়রাত করতেন। তাই রমজান মাসে আমাদেরও দান-খয়রাত, সমবেদনা ও সহমর্মিতা এবং পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার কাজে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। এটি সন্ধি ও নিষ্পত্তির মাস। এ জন্য এ মাসে ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করার ব্যাপারেও বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘কেউ তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে এলে তুমি তাকে বলে দাও, আমি রোজাদার।

মোদ্দকথা : রমজান শুধু সাহরি আর ইফতারি খাওয়ার নাম নয়; বরং এটি একটি প্রশিক্ষণ কোর্স, যা মুসলমানদের প্রতিবছর সম্পন্ন করতে হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, মানুষের সম্পর্ক তার খালিক-মালিক আল্লাহর সঙ্গে সুদৃঢ় করা, সর্বব্যাপারে মহান আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। সাধনা ও মুজাহাদার মাধ্যমে স্বীয় কু-রিপু ও কু-চরিত্রসমূহকে নিষ্পেষিত করা এবং নিজের উৎকৃষ্ট গুণাবলি ও নৈতিক উৎকর্ষতা সাধন করা।

মানুষের মধ্যে নেক কাজের অনুরাগ এবং গোনাহর কাজ পরিহার করার প্রেরণা জাগরুক করা। মানবহূদয়ে আল্লাহর ভয় এবং পরকালের চিন্তার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা। যা তাকে রাতের অন্ধকারে এবং বন ও প্রান্তরের নির্জনতায়ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। এরই নাম ‘তাকওয়া’। পবিত্র  কোরআন একেই রোজার মূল উদ্দেশ্য বলে ব্যক্ত করেছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যেন তোমাদের মধ্যে তাকওয়া জন্ম নেয়।’ (সুরা বাকারা) [লেখাটি শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি তাকি উসমানি দা. বা.-এর বয়ান থেকে অনুলিখন]

লেখক :মুফতি উবায়দুল হক খান

মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া গাজীপুর

Check Also

biye

ইসলামে স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করার পূর্বে স্বামীর মৃত্যু হলে কী করনীয়?

দেনমোহর কী : বিয়ের সময় স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করতে হবে, এটা স্বামী কর্তৃক প্রদেয় স্ত্রীর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin