র‌্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন সিনেটের নিষেধাজ্ঞা

র‌্যাবের সাবেক দুই কর্মকর্তা। বেনজির আহমেদ ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারী থেকে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত র‌্যাবের মহাপরিচালক এবং মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান র‌্যাবের উপ-মহাপরিচালক ছিলেন দীর্ঘ দিন। আমেরিকার সিনেট সদস্যদের বর্ণনা অনুযায়ী তারাই ৪ শতাধিক মানুষ খুনের জন্য দায়ী

বিচারবহির্ভূত হত্যার কারণে বাংলাদেশ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এর জ্যেষ্ঠ অধিনায়কদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ চেয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে চিঠি দিয়েছেন সিনেটের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটি। মঙ্গলবার সিনেটের র‌্যাংকিং সদস্য টড ইয়াং এর নেতৃত্বে বৈঠকের পর ডেমাক্রেট ও রিপাবলিকান দলের মোট ১০ জন সিনেট সদস্য একমত হয়ে এ চিঠি দেন। এতে বলা হয় ২০১৫ সালের পর থেকে ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে বিনা বিচারে খুন করেছে র‌্যাব।

পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং অর্থমন্ত্রী স্টিভেন নুচিনকে উদ্দেশ্য করে এই চিঠি দেন তারা। চিঠিতে তারা বিচার বহির্ভূত হত্যায় অভিযুক্ত জ্যেষ্ঠ র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানান। এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সব আইন ব্যবহারের কথাও উল্লেখ করা হয়।

সিনেটররা আরো বলেন যে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও অন্যান্য পন্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে।

চিঠিটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো:

ডিয়ার সেক্রেটারি পম্পেও এবং সেক্রেটারি নুচিন:

বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) কর্তৃক সংঘটিত চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ চিঠি লিখছি।

বাংলাদেশে ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার অভিযোগ রয়েছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে। এছাড়া,অনেক মানুষকে গুম করা ও নির্যাতনের অপরাধে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নেরই অংশ বলে প্রতীয়মান হয়েছে, এবং এসব ক্ষেত্রে র‌্যাবকে কখনও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য চিহ্নিত এসব জ্যেষ্ঠ র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগযোগ্য সব আইনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানাই।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেভাগে বাংলাদেশ সরকার ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করার পর থেকে র‌্যাব কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।

চিঠিতে আরো বলা হয়:

২০১৮ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সরকারকে দেয়া এক চিঠিতে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন যে, ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ কে সামনে রেখে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো দেখে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে এটা সরকারের একটি ‘ইচ্ছাকৃত নীতি’। এবং এটি বন্ধ করার জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়ে আইনের শাসন এবং মানবাধিকারকে সম্মানের আহ্বান জানানো হয়।

এতোকিছুর পরও, বাংলাদেশের সরকার এসব অপকর্ম বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং র‌্যাব সম্পূর্ণ দায়মুক্তি পেয়ে বিনাবিচারে মানুষ হত্যা করেই চলেছে।বিনা বিচারে মানুষ হত্যার পর প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’ এ নিহত হওয়ার দাবি করে র‌্যাব। কিন্তু, বাংলাদেশের স্বনামধন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায় যে, হত্যাকাণ্ডের অনেক দিন আগেই এসব ব্যক্তিকে ধরে র‌্যাবের হেফাজতে রাখা হয়। এছাড়া নিহত অনেকের শরীরের জখমের চিহ্ন দেখে বুঝা যায় যে তাকে/তাদেরকে বিনাবিচারে হত্যা করা হয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নথি থেকেও জানা যায় যে, কথিত বন্দুকযুদ্ধের অনেক সাক্ষীর সাথে কথা বলে জানা গেছে যে, র‌্যাব সদস্যরা তাদের সঙ্গে কথা না বলেই তাদেরকে সাক্ষী বানিয়েছে। তাদেরকে মনগড়া বিবৃতি দিতে জোর করেছে র‌্যাব।

চিঠিতে চাঞ্চল্যকর একরাম হত্যার প্রসঙ্গও উত্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়:

পৌর কাউন্সিলর একরামুল হককে হত্যার একটি অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায় যে, তাকে হত্যার পর র‌্যাব কর্মকর্তারা ক্রসফায়ার নাটক সাজানোর নির্দেশ দিচ্ছেন। ফাঁস হওয়া অডিও থেকে আরো জানা যায় যে, একরামুলকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার পর তার পকেটে মাদক ও গুলি রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন র‌্যাব কর্মকর্তা। এছাড়া নিহত একরামুলের হাত খুলে তার চারদিকে খালি বুলেটের খোসা ছড়িয়ে দেয়ার নির্দেশও দিচ্ছেন এলিট এই বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া কাছের একটি গাড়ীতে গুলির নির্দেশও দেয়া হয়, যা পুরোটাই ছিলো সাজানো।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও, র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুম, ব্যাপকভাবে নির্যাতনের দলিলপত্রও সংগ্রহ করেছেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো। বিশেষ করে, সরকারের শীর্ষ এক কর্মকর্তার সাথে বিবাদের জেরে এক সাবেক সেনা কর্মকর্তার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মীকেও গুমের অভিযোগ রয়েছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে।

গুম হওয়া ওই তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন র‌্যাবের ভয়াবহ নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পরে মারা যান। বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার বহু লোককে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করার আগে কয়েক দিন বা মাস ধরে জোর করে গুম করে রাখা হয়।

এসব কর্মকাণ্ডে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে এবং এতে অভিযুক্ত র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর জ্যেষ্ঠ নেতৃত্ব কোনো ধরণের পরিণতি ভোগ করেনি।

চিঠির শেষের প্যারায় বলা হয়:

ভয়াবহ মানবাধিকারের লঙ্ঘনের এসব ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। র‌্যাবের কর্মকর্তাদের দ্বারা চলমান এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় র‌্যাবের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ সব ধরণের আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের জন্য শক্ত প্রতিক্রিয়া জানানোর আহ্বান জানাই।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর র‌্যাবের নেতৃত্বে নতুন করে আবার গুমের ঘটনা শুরু হয়। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ফ্যাসিবাদী সরকারকে সুরক্ষা দিতে র‌্যাব কর্তৃক গুম, খুন ও ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের গল্পের আড়ালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নূতন মাত্রা পায়। বিরোধী নেতাদের গুম ও খুনের অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য। যে গুলোর নেতৃত্ব দিয়েছে র‌্যাব, তথা র‌্যাবে থাকা সেনা সদস্যরা।

দেশে কথিত ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধের গল্পের আড়ালে কী ঘটে এটা এখন সবাই জানেন। র‌্যাবে আসা সেনা সদস্যদের কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিরোধী নেতাকর্মীদের খুন এবং গুম করায় উৎসাহিত করতে রাষ্ট্রীয় পদকও দেয়া হয়। গুম, খুনে অনুপ্রেরণা দানকারী রাষ্ট্রীয় পদক প্রাপ্তির জন্য বরং নিজেদের গর্বিত মনে করেন র‌্যাবে আসা সেনা সদস্যরা।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে র‌্যাবের এক সময়ের উপপ্রধান জিয়ার নামটি গুম খুনের জন্য মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২০১৩ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে বিরোধী নেতাদের গুম এবং খুনে নেতৃত্ব দেয় র‌্যাব। আর এর মূল দায়িত্ব পালন করেন তখনকার র‌্যাবের উপ-প্রধান জিয়া। মনে করা হত র‌্যাবের জিয়া মানেই গুম খুনের নায়ক, রাষ্ট্রীয় খুনি বাহিনীর কমান্ডার। ২০১০ থেকে এ পর্যন্ত র‌্যাবের নেতৃত্বে বিরোধী দল গুলোর বহু নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। যাদের খোঁজ আজো মেলেনি। শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে এসব গুম এবং খুনের দায় ঘুরে ফিরে জিয়াদের মত র‌্যাবের নেতৃত্বে আসা সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপরই বর্তায়।

২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি বানচাল করতে এবং বিরোধী দল নিধনের মূল হাতিয়ার ছিল সেনাবাহিনী থেকে র‌্যাবে আসা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত ইউনিট। এছাড়া ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে রাস্তার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাতের অন্ধকারে অভিযানও পরিচালিত হয়েছিল ৩ জনের নেতৃত্বে। এর মধ্যে তৎকালীন বিডিআর প্রধান এম এ আজিজ (বর্তমানে সেনাপ্রধান), র‌্যাবের তৎকালীন উপ-প্রধান জিয়া ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে আসা। অন্যজন ছিলেন, ঢাকার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার ও বর্তমান আইজি বেনজির আহমদ।

এখানে উল্লেখ্য যে, বেনজির আহমেদ ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারী থেকে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। র‌্যাবের ডিজি থেকেই বেনজির আহমেদ সরাসরি পুলিশের আইজি হন। বর্তমানে র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্বে রয়েছেন।

গুম হওয়া মানুষদের পরিবার গুলোর সমন্বয়ে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে। মায়ের ডাক সংগঠনের অনেক পরিবার আপনজনদের ধরে নিয়ে গুম করার পেছনে র‌্যাবকে দায়ী করেন। তাদের অনেকেই দাবী করেন র‌্যাবের তৎকালীন উপ-প্রধান জিয়ার নেতৃত্বেই এসব গুম সংগঠিত হয়।

উৎসঃ   আমার দেশ

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin