বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশী কূটনীতিকদের সবসময় ভুমিকা ছিল। যদিও এ ভূমিকা এখন কমে গেছে। তারপরেও বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কুটনীতিকদের ওপর নির্ভর করে এবং কূটনীতিকদের মন জয় করে। গত ১২ বছরে এ ধারা কমে গেছে এবং কুটনীতিকরাই এখন নিজেদের সংকুচিত করেছে। এর কারণ একাধিক:
প্রধান কারণ হলো, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে সক্ষমতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ কোন কাজের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী নয়। আর এ কারণে কুটনীতিকরাও বাংলাদেশকে যেকোন বিষয়ে চাপ দিতে পারেন না। বাংলাদেশ বিশ্বের বিরল দেশগুলোর একটি। যে দেশগুলো ভারত এবং চিনের সঙ্গে সমান্তরাল সম্পর্ক রেখে চলেছে।
কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যেও কেউ কেউ মনে করেন কুটনীতিকরা হয়তো ক্ষমতা পরিবর্তনে বড় ধরনের ভুমিকা রাখতে পারেন। কুটনীতিকরা হয়তো সরকারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে সরকার চাপে পড়তে পারে।
আর এ কারণেই বিএনপি সবসমই কুটনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতারা ১৭ বার বিভিন্ন কুটনীতিকদের সঙ্গে দেখা-স্বাক্ষাত করেছেন, কথা বলেছেন, তাদের মন জয় করার চেষ্টা করেছিলেন। এসময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদের নেতেৃত্বে বিএনপির একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন দল ভারতে গিয়েছিল।
সেখানকার থিংক ট্যাংকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। এই সফরের মুল উদ্যেশ্য ছিল বিএনপির ব্যাপারে ভারত যেন সদয় হয়। আর নির্বাচনের পরও বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলারের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেই বৈঠকগুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য ড. কামাল হোসেনকেও সঙ্গে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব কোনো বৈঠকেই কূটনীতিকরা কোন ইতিবাচক সাড়া দেয়নি।
এখন আবার নতুন করে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কিন্তু কূটনীতিকরা কিছুতেই বিএনপির ব্যাপারে ইতিবাচক নয় এবং বিএনপিকে গুরুত্ব দিতে রাজি হচ্ছে না। এমনকি বিএনপিপন্থী কিছু সুশীল সমাজের ব্যক্তিরাও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব ইত্যাদি নিয়ে কথা বললেও কূটনীতিকরা তা গায়ে মাখে নি।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে যে, সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইস্যু এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সুশীলদের কয়েকজন প্রতিনিধি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূত এইসব বিষয় কে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে এড়িয়ে গেছেন। তিনি এনিয়ে আর আলোচনা করতে আগ্রহী হননি।
বিএনপি নেতারাও সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন দূতাবাসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে মার্কিন দূতাবাস বিএনপির সাথে এই মুহূর্তে বৈঠক করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বাদই দিলাম, ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত বিক্রম দোরাইস্বামী এসেছেন প্রায় ৪০ দিন হলো। এই ৪০ দিনের মধ্যে বিএনপি নেতারা একাধিকবার বীক্রম বিক্রম দোরাইস্বামীর সাথে ফটোসেশন বা আনুষ্ঠানিক বৈঠকের চেষ্টা করেছেন। বিক্রম দোরাইস্বামী এখন পর্যন্ত বিএনপি নেতৃবৃন্দের কারো সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক করেন নি।
শুধু বিক্রম দোরাইস্বামী কেন, কিছুদিন আগেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। সে সময় বিএনপি নেতারা তার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সে সাক্ষাত পাননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুটি দেশ। কিন্তু এর বাইরেও ব্রিটেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এবং রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই দেশগুলোর কূটনীতিকদের সঙ্গে এখন বিএনপি যোগাযোগ করতে পারছেন না। এর প্রধান কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে এখনও গলাতে চায়না বিদেশী রাষ্ট্রগুলো। বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে, তখন বাংলাদেশকে তারা একটি বড় বাজার হিসেবে দেখতে চায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়।
এমনকি একসময় বিএনপির অন্যতম মিত্র হিসেবে পরিচিত চীন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে এবং সরকার অখুশি হবে এই ভেবে বিএনপি নেতৃবৃন্দকে এড়িয়ে চলছে।
বিএনপি এবং জামাত সরকারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করার একমাত্র যে জায়গাটা ছিল, সেটি হলো কূটনীতিকপাড়া। সে পাড়াতেও তাদের অধিকার হারিয়েছে। এখন কূটনীতিকরাও বিএনপি-জামাতকে এড়িয়ে চলছে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম একটি মেরুকরণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বাংলা ইনসাইডার