bnp-flag

গতিশীল হচ্ছে বিএনপি, তারেক রহমান চাইলেই সব সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারছেন না

বিএনপিতে একটা সময় ছিল, যখন স্থায়ী কমিটির বৈঠক কবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, দলের নেতারা পর্যন্ত তা সহজে মনে করতে পারতেন না। এ জন্য দলে অনেক ক্ষোভও ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিএনপিতে এ পরিস্থিতি বদলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ প্রতি সপ্তাহের শনিবার দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠক নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির লাগাতার বৈঠকের কারণে সার্বিকভাবে বিএনপির কার্যক্রমে কিছুটা গতিশীলতা ফিরেছে। সিদ্ধান্তহীনতা ঘুচিয়ে বেশির ভাগ দলীয় সিদ্ধান্তই দলটির স্থায়ী কমিটি নিচ্ছে। অনেকের মতে, এর ফলে দল পরিচালনায় জবাবদিহির কিছুটা ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চাইলেই সব সিদ্ধান্ত নিজের ইচ্ছায় নিতে পারছেন না।

সর্বশেষ উদাহরণ হলো, ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনে তারেক রহমানের পছন্দের প্রার্থী ছিলেন নবীউল্লাহ নবী। কিন্তু স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত সালাহ্ উদ্দিন আহম্মেদকে মনোনয়ন দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, ‘বিএনপির মতো বড় দলে সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠক রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। কারণ এ দেশে এখন এক ব্যক্তির শাসন চলছে, যেখানে রাজনৈতিক দল তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। তবে নিয়মিত বৈঠক করে বিএনপি দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার পথ সুগম করছে।’

স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠকের কারণে বিএনপি গতিশীল হয়েছে—এমন দাবি করে মির্জা ফখরুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত দুই বছরের আলোচনায় সাংগঠনিক কার্যক্রম রিভিউ (পর্যালোচনা) করা ছাড়াও আমরা দলের রোডম্যাপ তৈরি করছি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্বহালের আন্দোলনকে কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, সেগুলো ঠিক করার পাশাপাশি দলের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশলও আমরা নির্ধারণ করব।’

জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দলকে গত ৩৮ বছরে নেতৃত্ব দিয়ে খালেদা জিয়া মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেলেও সিদ্ধান্তহীনতা তাঁর সময়ে বিএনপিতে সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয় ছিল। বলা হতো, সিদ্ধান্তহীনতাই বিএনপির ‘অলংকার’। আর ‘স্থিতাবস্থা’ খালেদা জিয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য—এমন আলোচনা দলটির মধ্যে এখনো আছে। অনেকের মতে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে চারদলীয় জোট সরকার গঠিত হলেও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে ওই সরকার অনেক দুর্নাম কুড়িয়েছে। সিদ্ধান্তহীনতার ক্ষেত্রে বিএনপিতে উদাহরণ হয়ে আছে অষ্টম সংসদে সরকারি দলে এবং নবম সংসদে বিরোধী দলে থাকাকালে সংসদে একজন উপনেতা নির্বাচন করতে না পারার ঘটনা।

বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭-এর (খ) ধারা অনুযায়ী দলের চেয়ারম্যান সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সব কমিটির ওপর তাঁর কর্তৃত্ব রয়েছে এবং দল পরিচালনায় তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে বা চেয়ারম্যান কর্তৃক অর্পিত যেকোনো দায়িত্ব সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে দেওয়া হলে তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ আছে। গঠনতন্ত্রের ওই ধারা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে বিএনপি। একটি দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ায় ওই দিনই খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হয়।

এর দুই দিন পরে ১০ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তারেকের সভাপতিত্বেই নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। গত ২৫ মার্চ খালেদা জিয়া কারামুক্ত হলেও দল পরিচালনার দায়িত্ব না নেওয়ায় ওই নিয়ম এখনো অব্যাহত আছে।

গত ৩০ মার্চ ও ৫ এপ্রিল থেকে তারেকের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির দ্বিতীয় দফা বৈঠক শুরু হয় এবং এর পর থেকেই মূলত বৈঠক থেকে কার্যকর সিদ্ধান্ত বের হয়ে আসতে শুরু করে। এখন প্রায় প্রতিটি ইস্যুতে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনার পর বিএনপি তার রাজনৈতিক অবস্থান জানাচ্ছে। পাশাপাশি ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিও পালন করছে।

স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, আগামী দিনে বিএনপি কিভাবে চলবে এবং কর্মকৌশল কী হবে তার রোডম্যাপ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করছে দলটির স্থায়ী কমিটি। বিশেষ করে সরকারকে পুরো পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ করতে দেওয়া হবে কি না এবং আন্দোলন কখন থেকে শুরু হবে, দলটির নেতারা এ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন।

পাশাপাশি রোডম্যাপ বাস্তবায়নে ২০১৭ সালের ১০ মে খালেদা জিয়ার উপস্থাপিত বিএনপির ‘ভিশন ২০৩০’ রূপকল্প নিয়েও আলোচনা চলছে। গণতন্ত্র, জাতি গঠন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ দল ও সরকার পরিচালনায় ওই রূপকল্পে মোট ২৫৬ দফা প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেছিলেন খালেদা জিয়া। 

স্থায়ী কমিটির বৈঠকের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির পর অনুষ্ঠিত দুই দিনের বৈঠকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিএনপির প্রণোদনা প্রস্তাব আলোচনা করে ঠিক করা হয়েছে। ওই প্রস্তাব দলের ভেতর ও বাইরে বেশ প্রশংসিত হয়েছে বলে জানা যায়।

এরপর গত ছয় মাসে অনুষ্ঠিত নিয়মিত বৈঠকে বিএনপির সব কটি বিভাগীয় কমিটি পর্যালোচনা করে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের সাংগঠনিক প্রতিবেদন স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোন কমিটিতে কোথায় কী সমস্যা রয়েছে, তা চিহ্নিত করে সমাধান করা হবে। এভাবে সব কটি বিভাগের ওই কাজ সম্পন্ন হলে দলের জাতীয় কাউন্সিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিএনপির বৈদেশিক নীতি কিভাবে নির্ধারণ করা যায় সে প্রশ্নে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। দলটি চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার নীতি অনুসরণ করে চলার পক্ষপাতী। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী বিএনপির কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জামায়াতকে ২০ দলীয় জোটে রাখা হবে কি না সে প্রশ্নে স্থায়ী কমিটির প্রায় সব সদস্য একমত হয়েছেন।

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মতামত দিলেই ওই প্রশ্নে সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে সুপারিশ করার জন্য জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও পৌর কমিটির সমন্বয়ে একটি কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। ওই কাঠামোর সুপারিশ অনুযায়ী এখন স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে।

গত কয়েক মাসে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে করোনা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচি নিয়েছে বিএনপি। দলটির নেতারা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, এরই মধ্যে তাঁরা দুই কোটি মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছাতে পেরেছেন।

এ ছাড়া গুম, খুন, মিথ্যা মামলা, ধর্ষণসহ সাম্প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি ও টাকা পাচার, রোহিঙ্গা ও মানবাধিকার ইস্যুতে সেমিনার, তিস্তার পানিবণ্টন ও করোনা মোকাবেলায় সরকারের অব্যবস্থাপনা, বাজেট ঘোষণার পরে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনার পর সংবাদ সম্মেলন করেছে বিএনপি।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, ‘প্রতি সপ্তাহে এজেন্ডা উত্থাপন করে নিয়মিত বৈঠকে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিএনপি আগের তুলনায় অনেক গতিশীল হয়েছে।’ তাঁর মতে, ‘এই উদ্যোগ অনেকটা ছায়া সরকারের মতো কাজ করছে।’ কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ইস্যুতে সরকারের চোখে আঙুল দিয়ে আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি যে কোথায় কোথায় তারা ভুল করছে, দুর্নীতি করছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘নিয়মিত বৈঠক অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ তৈরির পাশাপাশি দলে জবাবদিহির ক্ষেত্রও প্রস্তুত করছে।’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর মতে, ‘তারেক রহমানের নেতৃত্বে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে এখন আর কোনো সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকছে না। বিএনপি রাইট ট্র্যাকে (সঠিক পথে) চলে আসছে। দল চাঙ্গা হয়ে উঠছে।’

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin