khaleda-hasina

হাসিনা-খালেদা অনড় অবস্থানে, রাজনীতিতে অশনি সংকেত

আওয়ামী সরকারের দ্বিতীয় ধাপে চার বছর পেরিয়ে পঞ্চম ও শেষ বছরে পদাপর্ন করছে। ২০০৮ সালে প্রথম ধাপে ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্বাবধায়ক বা জরুরী সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ, সরকার গঠন করেই তত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে দেয় তারা।

এর ফলে বিএনপি সহ বিরোধী দলগুলো তত্বাবধায়ক পদ্ধতি বহালের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার এতে কর্ণপাত করেনি। এরমধ্যে ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি সহ কয়েকটি স্বল্প জয়প্রিয় দলের প্রশ্নবিদ্ধ অংশ গ্রহণে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সহ অধিকংশ দল নির্বাচন বর্জন করলে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যায়।

এমতাবস্থায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হয় এটি সংবিধান রক্ষার বা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। এই দাবি বিদেশিদের মধ্যেও প্রচার করতে থাকে। এর ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সহ বিদেশিরা ধরে নেয় সংবিধান রক্ষার বা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন শেষে হয়তো আরেকটি মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি থেকে খুব দ্রুতই সরে আসে আওয়ামী লীগ। আর নানারকম নাটকীয়তায় জাতীয় পার্টি সরকারের অংশ আবার নতুনধারার প্রধান বিরোধীদল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

অন্যদিকে বিএনপি সহ সরকারের বাহিরের দলগুলো প্রথমে তত্বাবধায়ক পদ্ধতি বহালের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে, কিন্তু আওয়ামী লীগের অনড় অবস্থানের কারণে সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসলে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় নির্বাচন বানচাল করতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুললেও দরকারের দৃঢ়তায় ও ব্যাপক দমন পীড়নের মাধ্যমে একতরফা নির্বাচন হয়ে যায়।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার সংবিধান রক্ষার বা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলে প্রচার করতে থাকলে বিএনপেও তা নীরবে মেনে নেয়। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণার বদলে পূর্ণমেয়াদে অর্থাৎ ২০১৮ সালের শেষে নির্বাচন হবে ঘোষণা দিয়ে সরকারি দলের নেতারা বক্তব্য দিতে থাকলে আবার ২০১৫ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বর্ষপূর্তি সামনে রেখে কঠোর আন্দোলনের পথে চলে আসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট।

বিএনপির মতে গণতন্ত্র হত্যার বর্ষপূর্তিতে ঢাকাসহ সারা দেশে সমাবেশ করতে চাইলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে তার অফিসে একপ্রকার বন্দি করে ফেলে। বন্দিদশা থেকেই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বিএনপি নেত্রী। প্রথম দিকে আন্দোলন সফলতার দিকে ধাবিত হলে সরকার কঠোর হস্তে তা দমন করে। আর হঠাৎ করে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী স্থগিত ঘোষণা দিলে বিএনপি চলে যায় রাজনীতির ব্যাকফুটে, মামলা আর সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিএনপি জোট নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে, ছিন্ন-বিভিন্ন হয়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। আর খালেদা জিয়া সহ নেতারা কোর্টে হাজিরার পর হাজিরা দিয়ে বর্তমান সরকারের বাকি সময় পার করছেন। এসময় মাঠে-ঘাটে কার্যকর কোন কর্মসূচী না দেওয়া প্রসঙ্গে জোট নেতারা বলছেন, সময়-সুযোগমত কার্যকর কর্মসূচী দেওয়া হবে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার কঠোর হস্তে বিএনপির আন্দোলন দমন করে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে। এমনকি বর্হিবিশ্বকে শান্ত করতে কূটনৈতিকভাবে সফল হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক চাপমুক্ত হয়ে অতি আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী সরকার এখন কোন আন্দোলন ও সমালোচনাকে পরোয়া করছে না। এ বছরের শেষে বা আগামী বছরের একেবারে শুরুতেই হওয়ার কথা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে। কার্যত তারা চাইছে বিএনপি জোট নির্বাচনে না আসুক, বর্হিবিশ্বকে শান্ত করার অভিজ্ঞতা থেকে আওয়ামী লীগ জোট ভাবছে, তাতে তেমন কোন সমস্যাও হবে না।

এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে স্পট করে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি-জামাত জোট সারাদেশে নির্মম সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়েছিল। নির্বাচনের দিন ৫৮২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়। হত্যা করে প্রিসাইডিং অফিসারসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।

এসময় প্রধানমন্ত্রী ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিতে গিয়ে বলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৫-এই তিন বছরে বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসীদের হাতে প্রায় ৫০০ নিরীহ মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হন। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গাড়ি, ২৯টি রেলগাড়ি ও ৯টি লঞ্চ পোড়ানো হয়। ৭০টি সরকারি অফিস ও স্থাপনা ভাংচুর এবং ৬টি ভূমি অফিসে আগুন দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষদিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। সংবধিান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বোতভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।

এসময় কঠোর হুশিয়ারি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন কোন মহল আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা করতে পারে। আপনাদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। জনগণ অশান্তি চান না। নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলনের নামে জনগণের জানমালের ক্ষতি করবেন- এটা আর এদেশের জনগণ মেনে নিবেন না।

আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারাও একই সুরে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কারও জন্য অপেক্ষা করবে না। বিএনপি না এলেও যথাসময়ে নির্বাচন হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে, শেখ হাসিনার অধীনে নয়।’

এদিকে সরকারের মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন সহ শরীক দলের কিছু নেতা, খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার কথা বলছে। তারা বিএনপি-জামায়াত জোট ছাড়া নির্বাচন হোক এমনটায় জানান দিচ্ছে। এমনটা হলে তাদের জন্য বেশি লাভ!

অন্যদিকে বর্তমান সরকারের চার বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ভাষণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে না; দুর্নীতির মহাসড়কে উঠেছে। সর্বত্রই দুর্নীতি রাহুগ্রাস দেশের সবকিছুকে গিলে ফেলছে।’

মির্জা ফখরুল আরো বলেন, ‘সবাই একটি সমঝোতার যখন আশা করছে, তখন এ ধরণের বক্তব্যে সবাই হতাশ। নির্বাচন ইস্যুতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেশকে আরেক দফায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।’

এর আগে বিএনপি জোট নেত্রী খালেদা জিয়া বারবার ঘোষণা দিয়ে আসছেন, হাসিনার অধীনে এদেশে কোন নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না। বিএনপির প্রভাবশালী নেতারাও একই সুরে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি ২০ দলীয় জোটের প্রভাবশালী নেতারাও বিএনপি নেতাদের সাথে একমত পোষণ করে।

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় কী হয় তা-ই দেখার অপেক্ষায় আছে তারা। আবার ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের মৃত্যুদন্ড চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।

খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা অভিযোগ করছেন মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে সরকার যেনতেনভাবে নির্বাচন দিয়ে সরকার আবার ক্ষমতায় থাকতে চায়। বিএনপি নেতারাও খালেদা জিয়া ছাড়া ও নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচন না হতে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আসছেন।

এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী জিয়া পরিবারের দূর্নীতিকে সামনে নিয়ে আসছেন, এর ফলে খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে অপপ্রচার বলে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। এমনকি পাল্টা উকিল নোটিশ পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

আবার প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে খালেদা জিয়া ও তার সন্তানদের দূর্নীতির বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। স্বভাবিকভাবে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির জায়গা বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে হারিয়ে গেছে বলে রাজনৈতিক সচেতন মহল মনে করছে।

এমতাবস্থায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দুই জোটের পরস্পর বিরোধী অনড় অবস্থান ও বক্তব্যের কারণে দেশি-বিদেশি সবার প্রশ্ন, রাজনীতিতে আবার অশনি সংকেত! বাংলাদেশের রাজনীতি এখন কোন পথে যাচ্ছে? আবার আন্দোলন, আবার সংঘাত, আবার হানাহানির কবলে পড়তে যাচ্ছে জাতি?

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin