হঠাৎ করেই তাবলিগ জামাতে একাধিক গ্রুপিং, অস্থিরতা

টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় ভারতের আলেম মাওলানা সা’দকে বাংলাদেশে আনাকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামাতের মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে একাধিক গ্রুপিং সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে আগামী ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য ইজতেমায় কার্যক্রম বাস্তবায়নে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তাবলিগ জামাতের ১১ জন শূরা সদস্যের মধ্যে প্রকাশ্যে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সংকট সমাধানের জন্য তাবলিগ জামাতের মুরুব্বিরা চেষ্টা করেও পারছেন না।

এদিকে বাংলাদেশের সর্বস্তরের আলেম ও তাবলিগ জামাতের অধিকাংশ মুরুব্বির সিদ্ধান্ত অমান্য করে কয়েকজনের স্বাক্ষর জাল করে ভারতের বিতর্কিত আলেম সা’দকে বিশ্ব ইজতেমায় আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন ঢাকার কাকরাইলের মুরুব্বি প্রকৌশলী সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম। আর তার এই চিঠির কারণে ফের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে তাবলিগ জামাতে।

আসন্ন তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমায় ভারতের মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ কান্ধলভির আগমনকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের একাধিক গ্রুপ। একই সঙ্গে এই দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশের তাবলিগ জামাতকর্মীদের মধ্যেও। কয়েকটি দেশের তাবলিগ জামাতের একাধিক গ্রুপ মাওলানা সা’দের বিশ্ব ইজতেমায় আসার পক্ষে-বিপক্ষে চিঠি দিচ্ছে বাংলাদেশকে। মাওলানা সা’দকে নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে তাবলিগ জামাতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ব ইজতেমার আগে মীমাংসিত একটি বিষয়কে উত্থাপন করে ফের বিতর্ক ছড়িয়ে দিচ্ছেন ওয়াসিফুল ইসলাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেয়া শূরার সদস্যদের নামে স্বাক্ষরিত চিঠিতে মাত্র ৪ জন শূরা সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে শূরা সদস্য নন এমন ২ জনের স্বাক্ষর নিয়েছেন তিনি। এরা হলেন আবদুল হামিদ মাসুম, অধ্যাপক আনোয়ার। তারা কেউ শূরার সদস্য নন। এ ছাড়া চিঠিতে যুক্ত শূরা সদস্য প্রফেসর ইউনূছ শিকাদারের স্বাক্ষরটি অন্য কারো হাতের। এতে ইউনূছ স্বাক্ষর করেননি।

তাবলিগ জামাতের সূত্র জানায়, তাবলিগের চিরকালীন মাহাত্ম্য নষ্ট করে সিনেমার নায়কদের দিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্কিত হয়েছেন ওয়াসিফুল ইসলাম। ইতোমধ্যে প্রত্যেক বছরে সপরিবারে হজে গমন, বিলাসবহুল গাড়িতে চড়া এবং কয়েক দফায় বিদেশি মেহমানদের প্রাপ্ত অর্থের হিসাব না দিয়ে কাকরাইলে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন ওয়াসিফুল ইসলাম।

তাবলিগের কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, ইজতেমাকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে অন্যত্র নেয়া এবং অস্থিরতা দেখিয়ে নিজের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু অন্যত্র সরাতেই ওয়াসিফ ভারতের সা’দকে নিয়ে বার বার বিতর্ক করছেন। ৭ জানুয়ারি তাবলিগ জামাতের মুরুব্বি ও কওমি আলেমদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি সা’দের ঢাকা সফরের প্রতি নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করেন। জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ীতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উলামায়ে কেরাম, কাকরাইলের শূরার উপদেষ্টা, কাকরাইলের শূরা ও ভারতে সফরকারী প্রতিনিধি দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ওই বৈঠকে ২১ জনের মধ্যে ১৩ জন এবারের ইজতেমায় মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর না আসার পক্ষে মত দেন। এরা হলেন বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা আশরাফ আলী, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহাদ্দিস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, তাবলিগের শূরা সদস্য মাওলানা মোহাম্মাদ যোবায়ের, মাওলানা মুহাম্মাদ হোসাইন ও মাওলানা ফারুক, বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী শিক্ষা সচিব মাওলানা আনাস মাদানী, তাবলিগের শূরা সদস্য মাওলানা উমর ফারুক ও মাওলানা রবিউল হক, শাইখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মাওলানা মিযানুর রহমান সাঈদ, হাটহাজারীর মুফতি কেফায়াতুল্লাহ, মাওলানা মুফতি মোহাম্মাদ আলী (আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদের প্রতিনিধি), ভারত সফরকারী প্রতিনিধি দলের সদস্য জামিয়া রাহমানিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক।

একই সঙ্গে এই ১৩ সদস্য দিল্লির নেজামুদ্দীন মারকাজের মুরুব্বি মাওলানা মুহাম্মাদ সা’দ ও মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ এবং নেজামুদ্দীনের বাইরের মাওলানা ইবরাহীম দেওলা ও মাওলানা আহমাদ লাটকে না এনে ইজতেমায় তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর সুপারিশ করেন। এরপর লিখিতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাকিস্তানের সাথীদের আসার প্রতিও নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। উদ্দেশ, বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব্যব্যাপী যে ষড়যন্ত্র চলছে, তা প্রতিরোধ করা।

একসময় ওয়াসিফুল ইসলামের কাছের হিসেবে পরিচিত এমন কয়েকজন তাবলিগ সাথী জানান, সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের আলেম, দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া থাকলেও সা’দের পক্ষে তিনি অবস্থান গ্রহণ করেছেন। যদিও এর কোনো কারণ তারা বলতে পারেননি।

এ বিষয়ে কাকরাইলের একাধিক তাবলিগের মুরুব্বি জানান, সৈয়দ ওয়াসিফের সহযোগী হিসেবে প্রকৌশলী আনিস, মাহফুজুল হান্নান, তাজুল ইসলাম, মোশাররফ হোসেন, ইয়াহইয়া, ব্যবসায়ী সিরাজ, সেলিমসহ আরো সাথীরা পাশে থাকলেও অস্থিরতার অভিযোগ এনে তার সঙ্গ ত্যাগ করেছেন। বিশেষ করে তাবলিগের উসূলের বিরোধিতা করায় সা’দের ইসলামী মানসিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ভারত ও বাংলাদেশে।

এমনকি সা’দের বিতর্কিত ইসলামী চিন্তা নিয়ে মালয়েশিয়া, আমেরিকা, সৌদি আরব, সাউথ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। যদিও ওয়াসিফ তার অনুগত প্রবাসীদের দিয়েও কয়েকটি চিঠি পাঠিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তাবলিগের সাথীরা অভিযোগ করেন, ২০১১ ও ১২ সালের দিকে জেদ্দার শেখ সুরুতির কাছ থেকে ৩ লাখ রিয়েল নিয়ে কাকরাইলে হিসাব দেননি। কাকরাইল মসজিদের কন্সট্রাকশনের জন্য কম্পিউটার কেনা হলেও তার ঠাঁই হয়েছে ওয়াসিফের বাসায়।

একসময়ের সৈয়দ ওয়াসিফের একজন কাছের সহযোগী জানান, সাধারণ তাবলিগের যারা মুরুব্বি হন, তাদের প্রত্যেকের জন্য তিন চিল্লা বাধ্যতামূলক। ভারত, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে চিল্লা দিতে হয়। সৈয়দ ওয়াসিফ তিন চিল্লা দেননি। এ ছাড়া ২০১২ সালের ইজতেমার মাঠে সিঙ্গাপুরের হাজি করিম ৫ হাজার ডলার দিলেও কাকরাইল মসজিদের অ্যাকাউন্টসে তা ওঠেনি।

সাধারণ তাবলিগের সাথীরা জামাতের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর দ্বন্দ্বে অসহায় হয়ে পড়েছেন। শঙ্কায় রয়েছেন, তাবলিগ জামাতকে ধ্বংস করতেই সম্মিলিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে ওয়াসিফুল ইসলাম বিতর্কিত সা’দকে ঢাকায় আনতে চান। এ বিষয়ে তাবলিগের মুরুব্বি ৭ জন মাওলানা সা’দের আসার পক্ষে মত দেন। এর মধ্যে শূরা সদস্য চারজন। সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, মুহাম্মাদ খান শাহাবুদ্দীন নাসিম, ইউনূছ শিকদার, মাওলানা মোশাররফ হোসাইন।

এদিকে মালয়েশিয়া থেকে আবদুল চং নামে এক চাইনিজ নওমুসলিমের কাছ থেকে একটি চিঠি আনান। ওই চিঠিতে বিশ্ব ইজতেমা মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়া হয়। যদিও মালয়েশিয়ার প্রবাসী বাঙালি তাবলিগ কর্মী জানিয়েছেন, ওই দেশে বিশ্ব ইজতেমা কখনই বাংলাদেশের মতো বড় করে সম্ভব না। ওই দেশে সারাদেশের ইজতেমাই ১০ ভাগে আয়োজন করা হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া তাবলিগের শূরার ৬ সদস্যের একটি চিঠি ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে আবদুল্লাহ চংয়ের চিঠির বিরোধিতা করে ঢাকার ইজতেমার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।

পাশাপাশি মাওলানা সা’দ ও বিতর্কিত আলেমরা যেন ঢাকার ইজতেমায় না আসেন, এজন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। সৈয়দ ওয়াসিফ চিঠি দিয়েছেন ৮ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
চিঠিতে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিজেকে ফায়সাল (সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী) ঘোষণা করেছেন। যদিও কাকরাইলের নিয়ম অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে ফায়সালের দায়িত্বে রয়েছেন মাওলানা ফারুক।সংগঠন সূত্রে আরো জানা গেছে, তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু হয় ভারতের দিল্লিতে মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াসের মাধ্যমে। তার মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী তাবলিগ জামাত ছড়িয়ে পড়ে।

সংগঠনটির মজলিশে শূরার সদস্য নির্বাচিত করা হয় দিল্লির নিজামুদ্দীন মারকাজ (মূল কেন্দ্র) থেকে। আর এই তাবলিগের কার্যক্রমে পাকিস্তানও অগ্রগামী ভূমিকায় রয়েছে। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের মারকাজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে রাজধানীর কাকরাইল মসজিদ। ১৯৬৭ সাল থেকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। এ ইজতেমায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুসলমান ছাড়াও বিশ্বের প্রায় দেশ থেকে তাবলিগের অনুসারী ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেন।

এদিকে টঙ্গীর তীরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসল্লিরা এই ইজতেমায় অংশ নেয়ায় এটি ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশে ছাড়াও বড় পরিসরে ভারত ও পাকিস্তানেও ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া অন্য অনেক দেশেই ছোট পরিসরে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলিগের মুরুব্বিদের অংশ গ্রহণেই এই ইজতেমা সর্বজনীনতা লাভ করে।

ভারত-পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বের জেরে দু’দেশের ইজতেমায় দু’দেশের তাবলিগের মুরুব্বিদের অংশ নেয়ার সুযোগ কম থাকে। এ ছাড়া ভিসা জটিলতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণেও অন্যান্য দেশের মুসল্লিদের অংশ নেয়ার সুযোগ বেশি থাকে না। অপরদিকে বাংলাদেশের ইজতেমায় ভারত-পাকিস্তানের মুরুব্বিরা সহজেই আসতে পারেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপেষকতার কারণে অন্য দেশের মুসল্লিরাও এই ইজতেমায় অংশ নেয়ার জন্য সহজে ভিসা পান।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের এক মুরুব্বি মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘সারাবিশ্বের তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় কোনো ইজতেমা বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান নেই। প্রত্যেক দেশ নিজে নিজ দেশে ইজতেমার আয়োজন করতে বাধা নেই। আবার একই সঙ্গে কোনো দেশের ইজতেমায় অন্য দেশের কর্মীদের অংশ নিতে কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।

মূলত ভারত-পাকিস্তানে তাবলিগের মুরুব্বিরা রয়েছেন, তাদের বয়ান শোনার জন্য অনেকে আগ্রহী। পাকিস্তানের ইজতেমায় ভারতীয় মুরুব্বিরা নানা কারণে অংশ নিতে পারেন না। অন্যদিকে নিরাপত্তাজনিত কারণেও অনেকে সে দেশে যেতে চান না। একই রকম ঘটনা ভারতের ইজতেমার ক্ষেত্রেও ঘটে। একমাত্র বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের শীর্ষ মুরুব্বিদের মিলনমেলা ঘটে। বাংলাদেশের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় অন্যান্য দেশের মানুষ আসেন।

উল্লেখ্য, এ বছর ১২ জানুয়ারি ও ১৯ জানুয়ারি দুই দফায় তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম দফায় ১৪ জানুয়ারি ও দ্বিতীয় দফায় ২১ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।

মানবকণ্ঠ

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin