সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য ছাড়া বিএনপির আন্দোলন কতটা সফল হবে

ছাত্ররা হলো যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান নিয়ামক। কোন বিপ্লবে, সংগ্রামে বা আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে সম্পৃক্ত করা না গেলে সেই আন্দোলন সফল করা কঠিন হয়ে যায়। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসে যতগুলো বড় অধ্যায় ছিল, বিশেষত বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান কিংবা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ- তার প্রতিটিতেই ছাত্রদের অংশগ্রহন ও ভুমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলন যেটা সেটা হলো ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলন সফল হওয়ার পেছনে মুল ক্রীড়ানক ছিল ছাত্রদের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ। রাজনৈতিক দলগুলোর জোটের বাইরে তখনকার সময়ের সকল ছাত্র সংগঠনগুলো মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিল যা তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল।

২০০০ সালে চারদলীয় জোটের অধীনেও একবার সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য গঠিত হয়েছিল। তৎকালীন ছাত্রশিবির সভাপতি নুরুল ইসলাম বুলবুল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাবীবুন্নবী খান সোহেল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, মরহুম নাসির উদ্দিন পিন্টুসহ অনেকেই সেই সময়ে ছাত্রঐক্য গঠনে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করেন।

অথচ ছাত্রঐক্যের সেই ধারাবাহিকতা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আর ধরে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আছে প্রায় ১০ বছর। তার আগে দুই বছর দেশ ছিল সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এই পুরোটা সময়েই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যকে সক্রিয় করা যায়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে ভাঙ্গা এবং জোটকে অকার্যকর করার জন্য ব্যপক ভিত্তিক কৌশল অবলম্বন করে।

জোটের প্রধান শরীক জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরকে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় আটক করে। ২০১৩ থেকে ১০১৬ সালের মধ্যে জামায়াতের শীর্ষ ৫ নেতা এবং বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্যকেও এইসব মামলায় ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়।

রাজনৈতিক নিপীড়নের এত বড় ন্যাক্কারজনক ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো হয়নি। তথাপি বিএনপি তার জোটের শরীকদের ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পারলে হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসটি ভিন্ন হতো।

সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগ আর যুবলীগ বাংলাদেশের সর্বত্র ব্যাপক তান্ডব ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি ক্যাম্পাসকে তারা অস্থিতিশীল করে তুলেছে। অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘাতকে কেন্দ্র করে বন্ধ হয়ে আছে। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী ছাত্র আন্দোলনগুলোকে বর্বর ভাবে আক্রমণ করছে। কোন সমালোচনা বা নিন্দাকেই তারা তোয়াক্কা করছেনা।

নিরীহ ছাত্রদেরকে হলে আটকে রেখে সারা রাত নির্যাতন করছে, ছাত্রলীগের নারী কর্মীরা আন্দোলনরত নিরীহ ছাত্রীদের উপরও আক্রমণ করছে, তাদের বস্ত্র হরণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভিসিসহ সার্বিকভাবে গোটা প্রশাসনকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ন্ত্রণ করার অপচেষ্টা করছে। অথচ ছাত্রলীগের এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে বিরোধী দলীয় ছাত্রসংগঠন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারেনি। পারলে ছাত্রলীগ এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারতোনা।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ইতোপূর্বে রোড ফর ডেমোক্রেসি বা ৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলা আন্দোলন কিংবা ৩ মাস ধরে চলা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেও ফসল ঘরে তুলতে পারেনি এবং সেই ব্যর্থতার জন্যও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের অনুপস্থিতিকেই দায়ী করেন।

যা বারোটা বাজার তাতো বেজেই গেছে, তবে এখনো জেগে উঠার সুযোগ রয়েছে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারী বিএনপি চেয়ারপার্সন ও জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তথাকথিত দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। অনেকেই মনে করছেন, এই রায়ের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠিয়ে নির্বাচন থেকে তাকে দূরে রাখতে চাইছে সরকার। এই যখন পরিস্থিতি, তখনো সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য সক্রিয় নয়। বিরোধী জোট নেতারা সম্প্রতি র্শীষ বৈঠক করলেও সেখান থেকেও ছাত্রঐক্য গঠনের কোন সিদ্ধান্ত আসেনি।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বড় দল হিসেবে বিএনপি এবং বড় ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রদলের যে উদারতা দেখানোর দরকার ছিল, তা না দেখানোর কারনেই এই সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য সক্রিয় করা যায়নি। যদি তাই হয় তাহলে বিষয়টা দু:খজনক। পরের ঘর পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য এতদিন বিএনপি নীরবে অবলোকন করেছে। এবার তার নিজের ঘরের কাছেই আগুন এসে গেছে।

এখনো যদি মানসিক সংকীর্নতা আর দলীয় সীমাবদ্ধতা থেকে তারা বেরিয়ে না আসতে পারে তাহলে আর কবে? আন্দোলনকে সফল করার জন্য, বিরোধী শীর্ষ নেতাদেরকে মুক্ত করার জন্য এবং সর্বোপরি এই সরকারের যদি তারা পরিবর্তন করতে চায় তাহলে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের কোন বিকল্প নেই।

৮ ফেব্রুয়ারীর রায়ের প্রাক্কালেও যদি এই সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য প্রতিষ্ঠা করে একে সক্রিয় না করা যায় তাহলে আর কবে হবে??

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin