সংস্কারের সৌদি ঝড়ে এক বছরেই ১০ হারাম হয়ে গেল হালাল

একেই বলে আধুনিক সৌদি আরব। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কারে এ বছর অন্তত ১০টি বিষয় হারাম থেকে পরিণত হয়েছে হালালে। ৩৫ বছর পর সিনেমা হারাম থেকে হালাল হয়ে যাওয়ার পর পশ্চিমা চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা ছুটছেন রিয়াদে। বিনিয়োগ হচ্ছে বিলিয়ন ডলারের।

তার আগে সৌদি আরব কোনো চলচ্চিত্র একাডেমি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ বা প্রশিক্ষণের কোনো প্রয়োজন মনে করেনি। ফলে পশ্চিমা অপসংস্কৃতির জোয়ারে সৌদি সংস্কৃতি ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে কয়েক বছরের মধ্যেই। ভিশন ২০৩০ এর অংশ হিসেবেই এ সংস্কারে সৌদি আরব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনি পুরোপুরি ঠাহর করা যাচ্ছে না।

প্রথমেই সংস্কারের অংশ হিসেবে গত সেপ্টেম্বরে মেয়েদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখন সৌদি নারীরা মোটর সাইকেল এমনকি ট্রাকও চালাতে পারবেন। এতদিন সৌদি ধর্মীয় নেতারা বয়ান করতেন নারীরা পুরুষের চেয়ে মস্তিষ্ক শক্তি এক তৃতীয়াংশ ধারণ করে বলে তারা গাড়ি চালাতে পারে না। এমনও বলেছেন নারীরা গাড়ি চালালে জরায়ুর ওপর চাপ পড়ে তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে।

সেই ধর্মীয় নেতারা এখন বেমালুম চুপ হয়ে গেছেন। অথচ এর আগে গাড়ি চালানোর দায়ে অনেক সৌদি নারীকে গ্রেফতার করে কম হেনস্তা করা হয়নি।

সৌদি সঙ্গীত জগতে পশ্চিমা কনসার্ট ও পপ সঙ্গীতের জোয়ার বইতে শুরু করেছে। এসেছেন ইয়ানি, নেলির মত সব বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীরা। পাইপ লাইনে আরো যারা আসবেন তাদের কনসার্টে উপচে পড়া সৌদি নারী পুরুষ দর্শকদের তালমাতাল উচ্ছাস দেশটির সংস্কৃতি কোনদিকে পৌঁছাবে বলা মুস্কিল। যদিও সৌদি ধর্মীয় নেতাদের মত গান বাজনা হারাম, এমন অন্য দেশের আলেমরা বয়ান করতেন তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না তারা এখন কোন মুখে কি বলবেন।

মার্কিন পপ সঙ্গীত ভিত্তিক যত আয়োজনের তোড়জোড় চলছে সৌদি আরব জুড়ে। এবছরের শুরুতেই ফেব্রুয়ারিতে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক পপ সঙ্গীত সম্মেলন ‘কমিক কন’ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল যেখানে পপ আর্ট, ভিডিও গেমিং, চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভিন্ন ইভেন্টে আন্তর্জাতিক কলাকুশলীরা অংশ নেন। যেখানে সৌদি আরবের মত দেশে চলচ্চিত্র দেখার মত বিষয় কল্পনাতেও স্থির ছিল না।

সৌদি সংস্কৃতিকে ধারণ করেই কোনো চলচ্চিত্র বা পশ্চিমা হলিউড বা অস্কারের কোনো বিকল্প পথে সৌদি আরব কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন পর্যন্তটুকু অনুধাবন না করে এ খাতে ছেড়ে দিচ্ছে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের হাতে। যেখানে নারী ও পুরুষের পৃথক বিনোদন ছিল সিদ্ধ সেখানে সিনেমাহলগুলোতে একসঙ্গে নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও দর্শক হয়ে চলচ্চিত্র উপভোগের ব্যবস্থা হারাম থেকে হালাল হয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টে পর্যন্ত সৌদি নারী ও পুরুষদের পৃথক বসার ব্যবস্থা অবশ্য এখনো চালু আছে।

প্রথমবারের মত স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে নারী ও পুরুষ আগামী বছর একসঙ্গে খেলা দেখতে পারবেন। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত সৌদি সমাজে এখনো নারীরা প্রকাশ্যে খেলাধুলায় অংশ নিতে পারে না।

আরেক সংস্কারের অংশ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে বিনোদন শহর। রিয়াদের বাইরে ৩৩৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ বিনোদন কেন্দ্রে থাকছে সাফারি পার্ক, খেলাধুলার ব্যবস্থা, থিম পার্ক ও অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থা। পুরো পশ্চিমা ধাঁচেই এসব বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। এর বাইরে ৬টি মার্কিন ডেভলপার প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ধারাবাহিকভাবে একাধিক থিম পার্ক সারা সৌদি আরবে নির্মাণের জন্যে।

সৌদি আরবে মিউজিক কনসার্ট এখন উপভোগের বিষয়। আরব দেশ ও আন্তর্জাতিক পপ সঙ্গীত শিল্পীরা একদিকে আসছেন, শো করছেন, উপচে পড়া দর্শক দেখে বিস্ময় বোধ করছেন, আরেকদিকে বিমান থেকে নামছেন আরেক দল পপ তারকা। ইয়েমেনের পপ তারকা সৌদি মাত করার পর গত সপ্তাহে আসেন লেবাননের পপ তারকা হিবা তাওয়াজি।

এমনিতেই সৌদি নাগরিকরা বাহরাইন ও দুবাইতে যেয়ে পশ্চিমা ধাঁচের চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচের খ্যাতি আছে। এধরনের খ্যাতি অর্জন সৌদি শেখরা ভারত থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলোতেও যেয়ে করেছেন। পাকিস্তানে হুবারা পাখি একমাত্র শিকার করেন আরব শেখরা।

দিন কয়েক আগেই কয়েক’শ উটের বহর পৌঁছে গেছে হুবারা পাখি শিকারে পাকিস্তানে। ভারতে এসে অল্পবয়স্কা গরীব মেয়েদের বিয়ে করে ভোগের পর পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে যাওয়ার ইতিহাস দীর্ঘ। কাজের মেয়েদের সঙ্গে যৌন নির্যাতনের ধকল সইতে না পেরে নেপাল, থাইল্যান্ড সহ একাধিক দেশ সৌদি আরবে নারী গৃহ শ্রমিক পাঠানো বন্ধ ঘোষণা করেছে বহু আগেই।

ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান বলছেন এধরনের ফুর্তি যা করার সে পরিবেশ সৌদি আরবেই তৈরি করতে যাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে অপচয় না হয়ে দেশটিতেই খরচ হয়। উৎপাদনশীল অর্থনীতি, উদ্যোক্তা বিকাশের বাইরে পুঁজি ও মেধা থাকা সত্ত্বেও সৌদিরা তা পশ্চিমাদের হাতে তুলে দিয়ে ভোগের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হচ্ছে।

প্রথমবারের মত সিনেমা শুধু জায়েজ করা হয়নি আগামী বছর থেকে লাইসেন্ট দেওয়া হচ্ছে সিনেমা হল চালু করার জন্যে। প্রথমেই মার্কিন চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান এএমসি এন্টারটেইনমেন্ট হোল্ডিং’এর সঙ্গে চুক্তি করেছেন সৌদি কর্তৃপক্ষ দেশটিতে সিনেমা প্রদর্শনের জন্যে। এ মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর বিশ্বে অন্তত ১ হাজার চলচ্চিত্র পরিবেশন করে।

ইয়োগা হালাল হয়ে গেছে সৌদি সংস্কৃতিতে। রীতিমত দাফতরিক ডিক্রি জারি করে ইয়োগা প্রশিক্ষণের দিক নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে ইয়োগা সেন্টার স্থাপনে। তবে এসব সংস্কার নিয়ে কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা করলে তাদের গ্রেফতার হতে হচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এধরনের আটকের নিন্দা জানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে বাকস্বাধীনতার দাবি করে আসছে।

এবিষয়ে কোনো সংস্কারের কোনো ইচ্ছা বিন সালমানের দেখা যাচ্ছে না। বরং পুরো বিশ্ব যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণায় ফুঁসে উঠেছে তখন সৌদি রয়াল কোর্ট ডিক্রি জারি করে বলেছে কোনো ধরনের প্রতিবাদ বিক্ষোভ যেন দেশটির মাটিতে না হয়। পশ্চিমা সংস্কৃতির বহর সৌদি আরবকে কোথায় নিয়ে যাবে তা ভেবে পুরো মুসলিম বিশ্ব শঙ্কিত।

হয়ত এজন্যেই তুরুস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, জেরুজালেমকে রক্ষা করতে না পারলে একদিন হয়ত মক্কা ও মদিনাকেও আমরা হারাব।

আস

Check Also

মুখ ফিরিয়ে নিলেন আত্মীয়স্বজন, হিন্দু বৃদ্ধের সৎকার করলেন মুসলিম যুবকরা

বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে মৃত্যু হয় ভারতের বুলন্দশহরের বাসিন্দা রবিশংকরের। অথচ প্রতিবেশীরা মনে করেন করোনা সংক্রমণের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin