bnp-flag

সংস্কারপন্থীদের ‘সংস্কার’ চায় বিএনপি

বিএনপির যেসব সংস্কারবাদী নেতা দলে ফিরে এসেও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন এবার তাদের ‘সংস্কার’ চান দলটির কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতারা। তাদের অভিযোগ, সংস্কারপন্থীরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও অধিকাংশ নেতাই নিজ-নিজ নির্বাচনি এলাকায় যান না। দলের কোনও কর্মসূচিতেও তাদের পাওয়া যায় না।

এমনকি এসব নেতার নির্বাচনি প্রচারণার সময় যেসব নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদেরও কোনও সহযোগিতা করেন না সংস্থারপন্থীরা। এই কারণে তৃণমূল নেতাদের দাবি, হয় সংস্কারপন্থীরা দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হবেন, না হলে দল থেকে তাদের বহিষ্কার করতে হবে। কারণ, দলের সংকটকালে যারা মাঠে থাকবেন, তাদের বঞ্চিত করে অর্থের বিনিময়ে সংস্কারপন্থীদের দিলে মনোনয়ন  দিলে দলের ভেতরে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। এতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়তে পারে। 

প্রসঙ্গত, সেনা-সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ২৬ জুন বিএনপিতে ১৫ দফা সংস্কার প্রস্তাব আনেন দলটির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। ওই সময় দলের একটি অংশ তাকে সমর্থন দেন। ওই সময় মান্নান ভূঁইয়া ও তার অনুসারীরা সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

তবে, এই সংস্কার প্রস্তাব আনার দায়ে ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর দল থেকে মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কার করলে সংস্কারপন্থীরা তার নেতৃত্বে তৎপরতা চালাতে থাকেন। কার্যত তখন থেকেই বিএনপিতে ‘সংস্কারপন্থী’ ও ‘মূলধারা’—এই দুটি পক্ষ তৈরি হয়। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিব হওয়ার পর বিভেদ আরও বাড়ে। মান্নান ভূঁইয়ার মৃত্যুর পর সংস্কারপন্থীরা কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েন।

এরপর ২০১৬ সালে সংস্কারপন্থীদের মধ্যে ১৮ জন নেতা বিএনপির কাছে লিখিতভাবে অঙ্গীকার করেন, তারা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির সঙ্গেই থাকতে চান। ওই বছরের ৫ জানুয়ারির আগে সাদেক হোসেন খোকার বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তারা ওই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেন। যা পরবর্তী সময়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে দেওয়া হয়।

সংস্কারপন্থী ওই নেতাদের পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে স্ব-স্ব এলাকায় গিয়ে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। অনেক পৌরসভায় প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে সংস্কারপন্থীদের পরামর্শও নেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের পর ওই বছরের ৩ আগস্ট ঘোষিত কমিটিতে নাম না থাকায় সংস্কারপন্থীরা হতাশ হয়ে পড়েন।

এর আগে, ২০১৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া সংস্কারপন্থী বিএনপির সাবেক তথ্য-গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ জহির উদ্দিন স্বপন ও   সর্দার সাখাওয়াত হোসেন বকুলকে ডেকে দলে সক্রিয় হতে বলেন। এরপর ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর মির্জা ফখরুলের হাত ধরে দলে ফেরেন ১০ সংস্কারপন্থী। তারা হলেন—সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী নওগাঁর আলমগীর কবীর, সাবেক হুইপ আবু ইউসুফ মো. খলিলুর রহমান, গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ (জিএম সিরাজ), ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, সুনামগঞ্জের নজির হোসেন, আতাউর রহমান আঙুর, আবু হেনা, শহীদুল আলম তালুকদার ও ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো। এর মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় আলমগীর কবির (নওগাঁ-৬), খলিলুর রহমান (জয়পুরহাট-২), আবু হেনা (রাজশাহী-৪), গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ (বগুড়া-৫), সর্দার সাখাওয়াত হোসেন বকুল (নরসিংদী-৪), নজির হোসেন (সুনামগঞ্জ-১), জহির উদ্দিন স্বপন (বরিশাল-১)। তারা কেউই নির্বাচনে জয়লাভ করেনি। তবে পরবর্তী সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেওয়া শূন্য ঘোষিত (বগুড়া-৬) আসনে উপ-নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিএম সিরাজ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

নওগাঁ জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, নির্বাচনের দিন এলাকা ছাড়েন সংস্কারপন্থী নেতা আলমগীর কবির। এরপর তাকে বিএনপির কোনও কর্মসূচিতে পাওয়া যায়নি। এমনকি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির যেসব নেতাকর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদেরও কোনও সহযোগিতা করেননি তিনি।

জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদুল ইসলাম ধলু বলেন, ‘নির্বাচনের দিন আলমগীর কবির এলাকা ছেড়ে গেছেন। এরপর আর আসেননি। কোনও কর্মসূচিতে তিনি উপস্থিত থাকেন না। ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের কোনও সহযোগিতাও করেননি।’

এক প্রশ্নের জবাবে ধলু বলেন, ‘নির্বাচনে মনোনয়ন তো খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম মিলে দেন। সেখানে আমাদের অভিমতের কোনও গুরুত্ব নেই। তবে, আমি মনে করি, যারা সারাবছর দলের কাজে সক্রিয় থাকবেন, তাদেরই মনোনয়ন দেওয়া উচিত। তিনি দলে থাকতে চাইলে অবশ্যই দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে ধলু আরও বলেন, ‘সংস্কাপন্থীদের মধ্যে যারা দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হবেন না, দল থেকে তাদের বহিষ্কার করা উচিত।’  

এই বিষয়ে জানতে চেয়ে বারবার ফোন করেও আলমগীর কবিরের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

এদিকে, বরিশাল বিএনপির নেতারা জানান, নির্বাচনের পরে এলাকায় গেলেও দলীয় কোনও কর্মকাণ্ডে পাওয়া যায়নি সংস্কারপন্থী নেতা জহির উদ্দিন স্বপনকে। ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের তিনি সাহায্য করেছেন, এমন কোনও খবরও নেই তাদের কাছে। তবে, ঢাকায় বিএনপির কিছু কিছু প্রোগামে তাকে অংশ নিতে দেখা যায় বলেও তারা মন্তব্য করেন।

জানতে চাইলে বরিশাল উত্তর বিএনপির সভাপতি মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ বলেন, ‘জেলায় কোনও কর্মসূচিতে  জহির উদ্দিন স্বপনকে দেখিনি। এলাকার কোনও প্রোগ্রামেও তাকে পাওয়া যায় না। তিনি দলে থাকতে চাইলে তো, তাকে দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় হতে হবে।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শে এসব বিষয়ে যেখানে রিপোর্ট করা দরকার,  সেখানে রিপোর্ট করা হয়েছে।’

সুনামগঞ্জ বিএনপির নেতারা জানান, সংস্কারপন্থীদের মধ্যে সুনামগঞ্জের নজির হোসেন মাঝে-মধ্যে জেলার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। নির্বাচনে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে কাউকে কাউকে আর্থিকভাবে কিছু সাহায্যও করেছেন।

জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচনে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদেরও কিছু সহযোগিতা করলেও দলীয় কর্মসূচিতে তাকে সক্রিয় হতে দেখা যায় না।’

এই প্রসঙ্গে সংস্কারপন্থী নেতা নাজির হোসেন বলেন, ‘যতটুকু সম্ভব, ক্ষতিগ্রস্ত নেতাদের সহযোগিতা করেছি। কিন্তু জেলা বিএনপিতে আমার কোনও পদ নেই। তাহলে আমি কীভাবে কর্মসূচিতে অংশ নেবো ?’

রাজশাহী বিএনপির নেতারা জানান, নির্বাচনের পরে এলাকায় দেখা যায়নি সংস্কারপন্থী নেতা আবু হেনাকে। দলের কোনও কর্মসূচিতেও তাকে পাওয়া যায় না। নির্বাচন কেন্দ্রীয় হামলা-মামলা শিকার হওয়া নেতাকর্মীদের কোনও সহযোগিতা করেনি তিনি। 

দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় না হওয়া প্রসঙ্গে রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, ‘নির্বাচনের পরে আবু হেনা আর রাজশাহীতে আসেননি। দেশের রাজনীতি করার পরিবেশ আছে নাকি? আমরা নিজেরাও তেমন কোনও কর্মকাণ্ড করতে পারি না।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কারপন্থী নেতা  আবু হেনা  বলেন,  নির্বাচনের পরে আমার এলাকায় দলীয় কোনও কর্মসূচি হয়নি।  তাহলে কীভাবে আমি কর্মসূচিতে যাবো?  দলে আমার কোনও পোস্টও নেই।  আমার  কোনও পোস্ট না থাকায় কোনও কর্মসূচিতেও যাই না।’

জয়পুরহাট বিএনপির নেতারা জানান, জেলা বিএনপির কর্মসূচিতে সংস্কারপন্থী নেতা খলিলুর রহমানকে পাওয়া যায় না। তবে আইনজীবী হিসেবে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের নামে থাকা মামলাগুলোয় সহযোগিতা করেন।

জয়পুরহাট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মেয়র ফজলুর রহমান বলেন, ‘খলিলুর রহমান প্রবীণ আইনজীবী। জর্জকোর্টে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন। বয়সও অনেক হয়েছে। ফলে জেলার কর্মসূচিগুলোতে তেমন থাকেন না।’

বগুড়া জেলা বিএনপির নেতারা জানান, সংস্কারপন্থী নেতা জিএম সিরাজের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি একমাত্র বিএনপির রাজনীতি করেন।  বগুড়া-৬ আসনে থেকে উপ-নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও এলাকায় যাতায়াত কম। তবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মসূচিগুলো মাঝে মাঝে অংশ গ্রহণ করেন।   

এই প্রসঙ্গে বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চাঁন বলেন, ‘এলাকার কর্মসূচিতে মাঝে মাঝে অংশ নেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গেও মোটামুটি ভালো সম্পর্ক রয়েছে তার।’

এদিকে, ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলামের হাত ধরে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ফারুক আলম সরকার বিএনপিতে দেন। গত নির্বাচনে তাকে গাইবান্ধা-৫ আসনে বিএনপি মনোনয়ন দেয়। স্থানীয় নেতারা জানান, প্রশাসনের চাপ উপেক্ষা করে যতটুকু সম্ভব বিএনপির রাজনীতি করে যাচ্ছেন ফারুক আলম। সামর্থ্য অনুযায়ী নির্বাচনে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাদের সাহায্যও করেন তিনি।  

গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সভাপতি মাইনুল হাসান সাদি বলেন, ‘ফারুক আলম নিজের উপজেলা দলের কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। জেলা পর্যায়ের প্রোগ্রামগুলোয়ও সাহায্য করেন।’

দলের পদ না থাকায় সংস্কারপন্থী নেতাদের বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় না হওয়ার অজুহাত প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সংস্কারপন্থীদের এখন পদ-পদবি দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ পদ-পদবি কাউন্সিলের মাধ্যমেই দিতে হবে। কাউন্সিলের পরে বোঝা যাবে, সংস্কারপন্থীরা কে কোন পদে আসছেন।’

খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘সংস্কারপন্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী জেলা পর্যায়ে কোথাও কোথাও পদ দেওয়া হচ্ছে। তবে তাদের বিষয়ে আগামী দিনের পরিকল্পনা কী, তা আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঠিক করবেন।’ 

দললের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, ‘সংস্কারপন্থী আরও কেউ বাকি থাকলে তাদেরও দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। দলে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার অঙ্গীকার করেই তো তারা ফিরে এসেছেন। এখন তাদের সক্রিয় হতে পদ-পদবি লাগবে কেন? তারা অনেকে সাবেক এমপি, এটাই তো বড় পরিচয়।’ যারা আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় হবেন, তাদের বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী সময়ে পদ-পদবি দেওয়া হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin