bnp-flag

শিগগির নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা

শিগগির নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবে বিএনপি। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে রূপরেখাটি তুলে দিতে চায় দলটি। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে দলটি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে চিঠি দেবে।

রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হবে। দলের নীতিনির্ধারক একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করে সমকালকে জানিয়েছেন, গতকাল মঙ্গলবার রাতে ওই রূপরেখার খসড়া চূড়ান্ত করতে বৈঠকে বসেছিলেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।

এই রূপরেখায় নির্বাচনকালীন সরকারের তিন মাস প্রধানমন্ত্রীকে ছুটিতে থাকার প্রস্তাব করা হবে। টেকনোক্র্যাট কোটায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের হাতে রাখারও প্রস্তাব করা হবে।

বিএনপি সূত্র জানায়, সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেও হাল ছাড়বেন না তারা। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি চলমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য উদ্যোগ নেবেন বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। এ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ জানাবেন তারা। তাদের মতে, অতীতে দেশের

যে কোনো সংকটে অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতিরাই বড় ভূমিকা পালন করেছেন; রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তারা আশা করেন, রাষ্ট্রপতি দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনায় সংকটের একটি সমাধানের পথ বের করবেন।

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর দশম সংসদের শেষ অধিবেশন বসবে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকলেও ভোটের আগে অনিবার্য কোনো প্রয়োজন ছাড়া আর অধিবেশন বসবে না। বিএনপি আশা করে, সংসদ অধিবেশন চলাকালেই রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেবেন। সবার সঙ্গে আলোচনায় ঐকমত্য হলে প্রয়োজনে ওই অধিবেশনেই সংবিধান সংশোধনের ব্যবস্থা করবেন।

সূত্র জানায়, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও থিঙ্কট্যাঙ্কদের তৈরি খসড়া রূপরেখাটি চূড়ান্ত করতে গতকাল রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে খসড়া রূপরেখা নিয়ে চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হয়। কিছু বিষয় সংযোজন ও বিয়োজন করেন তারা।

একই সঙ্গে খসড়া রূপরেখাটি দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘বিশেষ দূত’ মারফত এবং লন্ডনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছ থেকে টেলিফোনে অনুমোদন নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের ব্যবস্থা করতে হবে। অতীতের মতো আমরা যদি এক হতে পারি, তাহলে সংবিধান সংশোধন করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

নির্বাচনের আগে একটা সহায়ক সরকার প্রয়োজন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাদের সে সাহসও নেই। তাই ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করতে সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। যথাসময়ে সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়া হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল রাতে সমকালকে বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিএনপি অনেক আগেই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রায় তৈরি করে রেখেছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগেই তা প্রায় চূড়ান্ত করা হয়। বৈঠকের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

দলের একজন থিঙ্কট্যাঙ্ক নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার’-এর রূপরেখার খসড়া চূড়ান্ত করছে বিএনপি। হস্তক্ষেপমুক্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই হচ্ছে এর মূল প্রতিপাদ্য। কারাবন্দি হওয়ার আগে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার আস্থাভাজন থিঙ্কট্যাঙ্ক, অভিজ্ঞ সিনিয়র নেতা ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করে এই রূপরেখার খসড়া প্রণয়নের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

সে নির্দেশনার আলোকে দীর্ঘদিন ধরে খসড়া তৈরির কাজ করছেন তারা। চেয়ারপারসন কারাবন্দি হওয়ার পর লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে রূপরেখার খসড়া করা হয়।

দলের নীতিনির্ধারক সূত্র জানায়, নির্দলীয় সহায়ক সরকার সংবিধান সংশোধন করে গঠন করা সম্ভব। আবার সংবিধান সংশোধন না করেও নির্দলীয় সহায়ক সরকার গঠন করা সম্ভব। বিএনপির ওই রূপরেখায় দুটি প্রস্তাবই থাকবে। দুই প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী পদে নিরপেক্ষ কেউ অথবা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়টি থাকছে। এই সহায়ক সরকার হবে তিন মাস মেয়াদের। রাষ্ট্রপতির অধীনে নির্বাচনকালীন এই সরকারের মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট কোটায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সংস্থাপনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব থাকছে। রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের এসব মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেবেন। রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কাঠামো চূড়ান্ত করতে পারেন।

বিএনপির ওই নেতারা জানান, এই রূপরেখায় নির্বাচনকালীন তিন মাস প্রধানমন্ত্রীর ছুটিতে থাকার প্রস্তাব থাকছে। প্রধানমন্ত্রীর স্বপদে বহাল থেকে ছুটিতে থাকার মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের কাঠামোতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত নির্বাচনকালীন সরকারের কথাও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। যে সরকারে সংসদের তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, নির্দলীয় লোকদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। টেকনোক্র্যাট কোটায় স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সমকালকে বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কখনোই সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে হরতাল-অবরোধ হয়েছে। কাজেই যে নামেই হোক সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ একটি সহায়ক সরকার লাগবেই। নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। একইভাবে বিএনপির প্রস্তাবিত সহায়ক সরকার নিয়েও সংলাপ করার উদ্যোগ নেবেন বলে তিনি আশা করেন।

বৈঠকের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে গতরাতে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কারাবন্দি হওয়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন যাতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারে- সে উদ্দেশ্যেই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রয়োজন। বিএনপি নেতারা নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ভবিষ্যতে যথাসময়ে জাতির সামনে তুলে ধরার কথা বলেছিলেন।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দু’দফা সরকারবিরোধী আন্দোলন করে ব্যর্থ হয় বিএনপি। এরপর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে আসেন তারা। এখন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে ভাবছেন তারা। যাতে কিছু প্রক্রিয়াগত পার্থক্য থাকবে। এই সহায়ক সরকার পরিচালনা হতে পারে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে।

১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের শাসনামলে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। এরপর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে আদালত তা বাতিল ঘোষণা করেন। পরের মাসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে সরকার।

উৎসঃ   সমকাল

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin