লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রদল চালাচ্ছেন ২০ বাবা

লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাবারা। প্রায় সাত বছর আগে গঠিত জেলা কমিটির সভাপতি, তিন সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ ২০ জন নেতা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘর-সংসার করছেন। ১৫১ সদস্যের কমিটির আরও অন্তত ৩০ জন ব্যবসা ও ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে যুক্ত। এই কমিটির কতজনের বর্তমানে ছাত্রত্ব রয়েছে তা বলতে পারেননি বিবাহিত সভাপতি।

জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হারুনুর রশিদ ১০ বছর আগে বিয়ে করেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সাত বছর ধরে ঠিকাদারি করছেন তিনি। সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল আলম (মামুন) পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেন। তিনিও এক সন্তানের বাবা। এখন ওষুধের ব্যবসা করছেন।

জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি ফয়েজ আহম্মেদ বিয়ে করেছেন ১০ বছর আগে। তাঁর বড় মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। অন্য দুই সহসভাপতি বদরুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমান ২০১৫ সালে বিয়ে করেন। যুগ্ম সম্পাদক শামছুর রহমান গত বছর বিয়ে করেন। এ ছাড়া কমিটির আরও ১৪ জন নেতা বিয়ের পর ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত।

বিবাহিতদের বাইরে অন্য নেতাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। এর মধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদক এম মমিনের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে ছয় বছর আগে। এখন ব্যবসা করছেন তিনি।

জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির অনেক নেতাই বিবাহিত এটি সত্য। কিন্তু তাঁরা দলের সব কর্মসূচিতে অংশ নেন।

সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল আলম বলেন, যখন তিনি দায়িত্ব পান তখন বিয়ে করেননি। কমিটির বেশির ভাগ সদস্যের ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুনদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন তাঁরা।

ছাত্রদলের অনুমোদিত কোনো গঠনতন্ত্র নেই। একটি খসড়া গঠনতন্ত্র থাকলেও তাতে বয়সের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এতে বলা আছে, মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্রদলের সদস্য হতে পারবেন। তবে বিবাহিত, ৪০ পেরিয়ে যাওয়া এবং ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া কাউকে নেতৃত্বে না আনার অলিখিত নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা চলে। জেলা কমিটির মেয়াদ তিন বছর। তবে লক্ষ্মীপুর ছাত্রদলের কমিটি চলছে প্রায় সাত বছর ধরে।

ছাত্রদেরই ছাত্রদল করা উচিত জানিয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মামুনুর রশিদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা বিবাহিত তাঁদের ছাত্রদল করা ঠিক নয়। লক্ষ্মীপুর জেলার ছাত্রদলের কমিটি সবচেয়ে পুরনো। জেলা ছাত্রদলের কার্যকারী কমিটির শীর্ষনেতারা অনেকেই বিবাহিত এটি জানেন তাঁরা। কিন্তু নানা কারণে সেখানে নতুন কমিটি করা যায়নি। ছাত্রত্ব রয়েছে এবং বিবাহিত নয় এমন নেতাদের দিয়ে আগামী বছরের শুরুতে নতুন কমিটি করা হবে।

লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির তিনজন দায়িত্বশীল নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রদলের নেতারা থাকবেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে তাঁরা কাজ করবেন। কিন্তু জেলা ছাত্রদলের আদু ভাই নেতারা ব্যস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে। পদ আকড়ে ধরে রাখতে নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা।

বিএনপিতে ‘খায়েরতন্ত্র’

চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, ভাতিজাসহ নিজের আত্মীয়স্বজনকে দলের বিভিন্ন কমিটির নেতা বানিয়েছেন লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া। তাঁর চাচাতো ভাই আবদুল করিম ভূঁইয়া লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা (পশ্চিম) কমিটির আহ্বায়ক। একই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক তাঁর মামাতো ভাই মাহাবুবুর রহমান। নিজের আত্মীয়দের দিয়ে দল চালানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ নেতা-কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, লক্ষ্মীপুরে বিএনপির রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র চলছে।

দলীয় সূত্র জানায়, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদককে না জানিয়ে গত ২৮ নভেম্বর নিজ বাড়িতে সভা ডেকে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পশ্চিমের কমিটি বিলুপ্ত করেন আবুল খায়ের ভূঁইয়া। বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে বাদ দিতেই কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। নতুন কমিটির আহ্বায়ক আবদুল করিম ভূঁইয়া রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও যুগ্ম আহ্বায়ক কখনো রাজনীতি করতেন না। তিনি ঢাকায় থাকেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই।

হঠাৎ করে কমিটি বাতিল করায় গত ৩০ নভেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন (সাবু) দলের মহাসচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। এতে বলা হয়, আবুল খায়ের ভূঁইয়া স্বৈরতান্ত্রিকভাবে দল চালাচ্ছেন। স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটি গঠন করেছেন তিনি।

লক্ষ্মীপুরে বিএনপির রাজনীতিতে এখন আর পরিবারতন্ত্র নয় ‘খায়েরতন্ত্র’ চলছে বলে মন্তব্য করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন।

তবে দলের মধ্যে পরিবারতন্ত্র কায়েম করার অভিযোগ সঠিক নয় বলে জানান আবুল খায়ের ভূঁইয়া। তিনি বলেন, তাঁর আত্মীয়রা যোগ্যতার কারণেই বিভিন্ন কমিটিতে পদ পেয়েছেন। তাঁদের প্রতি নেতা-কর্মীদের সমর্থন রয়েছে। সদর পশ্চিমের কমিটি নিষ্ক্রিয় থাকায় নেতা-কর্মীদের মতামত নিয়ে তা বিলুপ্ত করেন তিনি। ওই সভায় জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদককে আসতে বলা হলেও তিনি আসেননি।

জেলা বিএনপির সভাপতি হওয়ার আগে আবুল খায়ের ভূঁইয়া ২০০২ সালে লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর উপজেলা ও সদর উপজেলার আংশিক) আসন থেকে উপনির্বাচনে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন। পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবারও সাংসদ হন তিনি। ২০০৩ সাল থেকে তিনি জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

আবুল খায়ের সভাপতি হওয়ার পর তাঁর এক ভাতিজা আবুল ফয়েজ ভূঁইয়াকে জেলা কমিটির সদস্য করেন। আরেক ভাতিজা শাহাদাত হোসেনকে জেলা যুবদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির পদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সদর পশ্চিম স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক জাকির হোসেন ভূঁইয়া, সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি করা হয় সাইফুল ইসলামকে এবং সদর পশ্চিম যুবদলের আহ্বায়ক মো. মহিউদ্দিনকে। এই তিনজনও তাঁর আত্মীয়। এ ছাড়া দলের বিভিন্ন কমিটিতে তাঁর আরও ১৫ আত্মীয় দলীয় পদ পেয়েছেন।

আবুল খায়েরের চাচাতো ভাই আবদুল করিম ভূঁইয়া বলেন, দল যোগ্য মনে করেই তাঁকে নেতৃত্বে এনেছে। একই দাবি করলেন জেলা বিএনপির সদস্য আবুল ফয়েজ ভূঁইয়া এবং জেলা যুবদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শাহাদাত হোসেন।

দলের সব স্তরে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আবুল খায়ের ভূঁইয়ার পরিবারতন্ত্র চালু করেছেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হাছিবুর রহমান। তিনি বলেন, ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করায় লক্ষ্মীপুরে সাংগঠনিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বিএনপি।

সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের বিরোধকে কেন্দ্র করে গত ২৮ নভেম্বর থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর পৌর ছাত্রদল, সদর (পশ্চিম) যুবদল এবং বিএনপির উপজেলা (সদর পশ্চিম) পর্যায়ে পাল্টাপাল্টি মোট ছয়টি কমিটি হয়েছে।

জেলা বিএনপির সম্মেলন না হওয়ার জন্যও খায়ের ভূঁইয়াকে দায়ী করেন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন। তাঁর দাবি, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সব সময় আপস করে রাজনীতি করেন তিনি (খায়ের)।

তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপস করার অভিযোগ অপপ্রচার বলে দাবি করেন আবুল খায়ের ভূঁইয়া। সম্মেলনের বিষয়ে তাঁর দাবি, কেন্দ্রের নির্দেশেই আপাতত সম্মেলন হচ্ছে না। আগামী সংসদ নির্বাচনের পর সম্মেলন হবে।

লক্ষ্মীপুর জেলা কমিটির সভাপতির আত্মীয়রা দলের বিভিন্ন কমিটিতে জায়গা পাওয়ায় নেতা-কর্মীদের মাঝে অসন্তোষ রয়েছে বলে স্বীকার করেন বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহসাংগঠনিক সম্পাদক হারুনুর রশিদ। তিনি বলেন, সভাপতির বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্র চালু করা নিয়ে কমিটির সাধারণ সম্পাদকের করা অভিযোগ তাঁরা পেয়েছেন।

prothom-alo

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin