রাজনীতি হচ্ছে কৌশলের খেলা, শামীম ওসমান কৌশলে ফেল করেছে : কবরী

নারায়ণগঞ্জ জেলার পাচঁটি আসনের নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনটি গত ২২ বছর ধরে বেশ আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৬ সালে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা একেএম শামীম ওসমান। ২০০১ সালে বিএনপির গিয়াসউদ্দিন এমপি হন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনে চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী নির্বাচিত হন।

কবরী সাংসদ থাকার সময় শামীম ওসমানের সঙ্গে তার মনোমালিন্য দেখা দেয়। এ ঘটনা প্রকাশ্যে আসলে সারা দেশে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন পর সেই ঘটনা নিয়ে “সেন্স অফ হিউমার” নামের একটি টিভি অনুষ্ঠানে কথা বলেন কবরী সারোয়ার। এর আগে এখানে শামীম ওসমানও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

উপস্থাপক শাহরিয়ার জয়ের প্রশ্নের জবাবে কবরী বলেন, ‘শামীম ওসমানের কাছে হেরি গেছি, নাতো। আমি তো জিতে এসেছি। আমি হারি নাই। ওর কাছে কী হারবো। চুটকি বাজিয়ে কাজ করেছি ৫ বছর। আমাকে প্রধানমন্ত্রী নোমিনেট করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে কবরীকে তুলে দিলাম। আপনারা ভোট দিয়ে তাকে জিতাবেন। নৌকা মার্কায় ভোট দিবেন। এটা ছিল আওয়ামীলীগের স্লোগান। আওয়ামীলীগ আমার দল। আমি গর্ব করি। আমি যখন কাজ করতে গেলাম। হু দ্যা হেল হিজ। ও কথা বলবে কেন। আমাকে প্রধানমন্ত্রী নোমিনেট করেছে। আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমি সিলেকশনে আসি নাই। আমি কিন্তু ইলেকশান করে এসেছি। আমি নারায়ণগঞ্জ-৪ এ ইলেকশন করেছি। ডোর টু ডোর ভোট চেয়েছি। ভোটে চেয়ে পাশ করে এসেছি। রাজনীতি হচ্ছে একটি কৌশলের খেলা। শামীম ওসমান কৌশল করতে গেছিল। আমি জানি না। উনি কৌশলে ফেল করেছে।

শামীম ওসমানকে ইঙ্গিত করে কবরী বলেন, আমার চেয়ে কী ভাল অবস্থানে আছে? টাকা পয়সা দিয়ে ভাল অবস্থানে। আমি নিষ্ক্রিয়? আমি তো ওর চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়। আমি এমপি না, তারপরও আমি ওর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আমি ওনেক সম্মান নিয়ে বেড়াচ্ছি।

সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, সামনে কোন নির্বাচন করবো কি না, তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রি জানেন। ওনার রাজনীতি কিভাবে সাজাবেন। রাজনীতি একটি সংসার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক শক্তিশালী। বিশ্বের ১৭ কোটি বাঙালী মানুষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার অনেক মেধা। তিনি আগেই অনেক কিছু বুঝতে পারেন। সুতরাং ওনি যদি মনে করেন তাহলে নোমিনেশন দিবেন। নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার আগে আমি একবারও ভাবি নাই। আমি জানি সিলেকশনে আসবো। ইলেকশান করতে চাইনি। ইলেশনকে ভয় পাইছি।

কবরী বলেন, শামীম-আইভীর যে দ্বন্দ্ব আমি এতে কাউকে সমর্থন দিতে চাই না, বিরুদ্ধে বলতেও চাই না। আমিতো ফেইস করেছি। যার যার তাকেই ফেইস করতে হবে। কারণ আপনাকে যখন একটি জায়গায় নামিয়ে দেয়া হবে তখন তো আপনি বুঝবেন কী ভাবে ঠেলা সামলাতে হবে। আমি তো বুঝেছি।

তিনি আরো বলেন, আমি একটি পেশাদার জায়গা থেকে রাজনীতি করবো। আমি একটি সিস্টেমে মধ্যে বড় হয়েছি। ১৩ বছর বয়সে বাড়ী-ঘর ছেড়ে কাজে বেরিয়েছে। আমি সাধারন মানুষের কাতারের মানুষ। খোদাতা’লার অশেষ রহম। মানির মান রাখছে। আমি যদি হারতাম কষ্ট লাগতো। কারন মানুষ যে ভালবাসে। শামীম ওসমান সাকসেস ফুল কী ভাবে, আমিতো এমপি না তারপরও মানুষ আমাকে ভালবাসে। ওনার কথা কয়জনে শুনে জানি না, কিন্ত আমার কথা অনেকে শুনে।

প্রসঙ্গত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন শিল্পপতি শাহআলম। কিন্তু এ আসনে নির্বাচিত হয় আওয়ামীলীগের টিকেট পাওয়া চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। কিন্তু নির্বাচনের পর থেকেই গার্মেন্ট ঝুট ব্যবসা, চোরাই জ্বালানী তেল, টেন্ডারবাজীর নিয়ন্ত্রন ও এলাকার আধিপত্য নিয়ে বিতর্কের সম্মুখীন হন এমপি কবরী। আলীগঞ্জ এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে কবরীর পক্ষে মাসল ম্যান হিসেবে ছিলেন শ্রমিকলীগ নেতা কাওসার আহমেদ পলাশ। পরে তাদের সম্পর্কও বিরোধপূর্ণ হয়।

জানা গেছে, চট্রগ্রামের অখ্যাত কিশোরী মীনা পাল ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কবরী হিসেবে পরিচিতি পান। শ্যামবর্ণের এই নায়িকা ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে হয়ে উঠেন মিষ্টি মেয়ে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পান আচমকা। তখন থেকেই বদলে যেতে থাকে তার রুপ। বহিরাগত এই জনপ্রতিনিধি নিজের পিএস নিয়োগ দেন আরেক বহিরাগত শ্যামপুরের সিরাজুল ইসলাম সেন্টুকে। সুদর্শন এই যুবকের বিদ্যার দৌড় বেশী না থাকলেও তার প্রতি কবরীর অনুরাগ ছিল বেশ আলোচিত। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছেন এ জুটি। নেই কবরী নেই সেন্টুও।

নির্বাচনের সময় ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা কবরীর পেছনে শ্রম ও অর্থ ব্যয় করলেও জয়ী হওয়ার পর দ্রুত ভুলে যান তাদের। কাছে টেনে নেন মুখচেনা কিছু লোককে। যাদের মধ্যে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অন্যদলের লোকজন রয়েছে। প্রথমদিকে যারা ছিলেন পরে তাদের অনেকেই তাকে ছেড়ে যান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রমিক লীগ নেতা কাউসার আহম্মেদ পলাশ, যুবলীগ নেতা মীর সোহেল আলী, আওয়ামীলীগের শফিকুল ইসলাম। মীর সোহেল একাধিকবার কবরী বলয়ে আসা যাওয়া করেছে।

ক্ষমতা পেয়ে একের পর এক অপকর্ম করতে থাকে কবরী ও তার পিএস। ফতুল্লার চোরাই তেল, জুট সেক্টর, ভূমি এমনকি মাদক সেক্টরও নিয়ন্ত্রন করে তারা। মাদক নিয়ে পাগলায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় শুভ নামে এক কিশোর নিহত হয়। আলীগঞ্জে যমুনা ডিপোর একটি জমি নিয়ে পলাশ সমর্থকদের সাথে সংঘর্ষ হয় কবরী গ্রুপের। ওই ঘটনায় পিস্তল উঁচিয়ে ফতুল্লা থানায় প্রবেশ করে পিএস সেন্টু তৎকালীন ওসি জীবন কান্তি সরকারের নাম ধরে ডাকাডাকি করে। ওসি থানার বাইরে থাকায় তার চেয়ারে বসে সেন্টু। ওই সময়ে তার চারপাশে ঘিরে থাকে সন্ত্রাসীরা।

এলাকার আধিপত্য নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সোহেল ওরফে শ্যূটার সোহেলকে হত্যা করার অভিযোগে কবরী পন্থী খেলাফত, মীর্জা পাভেল, ডাকাত আব্দুলসহ কয়েকজনের নামে মামলা হয়। ওই সময়ে কবরীর প্রভাবে এই মামলায় পিএস সেন্টুর নাম দেয়া যায়নি।

সেই সময়ে কবরীর কাছের লোক ছিলেন থানা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক মো. শহিদুল্লাহ, ফতুল্লার আউয়াল, স্বপন চেয়ারম্যান, শিশির, রনি, খেলাফত, পঞ্চবটির শফিক, লিপু, স্বপন সরদার, মীর্জা পাভেল, ভোলাইলের শামীম, মাসদাইর পাকাপুলের ডাকাত আব্দুলসহ আরো কিছু লোক। তাদের অনেকেই এখন কবরীকে ভুলে শামীম ওসমান বলয়ে এসেছে।

সংসদ সদস্য থাকাকালীন ঝগড়া করেও আলোচিত হন কবরী। ওই সময়ে একাধিক রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধির সাথে প্রকাশ্য ঝগড়া করেন তিনি। ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক শওকত আলীকে গ্রেফতার ও মারধরের ঘটনা কবরীর নির্দেশে হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin