ওয়ান ইলিভেনের পর সেনাসমর্থিত ফখরউদ্দীন-মঈনউদ্দীন সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিনা ওয়ারেন্টে তথাকথিত মামলার আসামি করে তারেক রহমানকে ঢাকা ক্যান্টমেন্টস্থ মইনুল রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে যৌথবাহিনী।
সেদিন অনেকটা নাটকীয়ভাবেই বেগম খালেদা জিয়ার সামনে থেকে তারেক রহমানকে জোর করেই তুলে নিয়েছিল যৌথ বাহিনী। পরে বেগম খালেদা জিয়া ও আরাফাত রহমান কোকোকেও গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী।
২০০৮ সালের ১৮ জানুয়ারী তখনো খালেদা জিয়া মইন-ফখরুদ্দীনের রোষানলের বিশেষ জেলে আটক। তার দুই ছেলেও কারাবন্দি। এই দিনে হঠাৎ খালেদা জিয়ার মমতাময়ী মা তৈয়বা মজুমদার ইন্তেকাল করেন। জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
প্যারোলে মুক্তি পেয়ে মায়ের লাশ দেখেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। মহানগরীরর আজাদ মসজিদে অনুষ্ঠিত জানাজা নামাজে শরিক হন বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার ছোটভাই আরাফাত রহমান কোকো। কোকোও আজ নেই। তারেক রহমানও চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নির্বাসনে।
১৯২০ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিলিগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তৈয়বা মজুমদার। মরহুমা তৈয়বা মজুমদারের তিন মেয়ের মধ্যে সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী খুরশিদ জাহান হক ২০০৭ সালে ইন্তেকাল করেন। দুই ছেলে হলেন মেজর (অব.) সাইদ এস্কান্দার ও শামীম এস্কান্দার। সাঈদ এস্কান্দারও ইন্তেকাল করেছেন।
এদিকে ওয়ান ইলিভেনে গুলশান থানায় তথাকথিত এক কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে ব্যবসায়ী আমিন আহমেদ চৌধুরীর দায়ের করা মামলায় প্রথমে তারেককে চার দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়। পরে ছয় দফায় ১৩ দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন আদালত। একেক করে তার বিরুদ্ধে মোট ১৩ টি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।
৭ মার্চ গভীর রাতে গ্রেপ্তারের, তারেক রহমান এক স্বজনকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকে নিতে এসেছে। আমি কোনো অপরাধ করিনি, আমার জন্যে দোয়া করবেন।’
রাতভর নানা নাটকীয়তার পর ভোরে মা বেগম খালেদা জিয়ার অঝোর কান্না আর প্রতিবাদের মধ্যেই তারেককে নিয়ে যায় যৌথ বাহিনী। ১৩ টি মামলায় জামিন পাওয়ার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তারেক রহমান তখন আর সুস্থ নেই। অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে স্ট্রেচারে গিয়ে লন্ডনের প্লেনে উঠেছিলেন ১১ সেপ্টেম্বর। ৫৫৪ দিন কারাবাসের পর লন্ডনে যাওয়ার আগে পিজি হাসপাতালে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়। কান্নায় ভেঙে পড়া মায়ের বুকে বেদনার্ত তারেকের রোদন ও বাষ্পরুদ্ধ কথোপকথন পিজি হাসপাতালের বাতাসকে ভারি করে তুলেছিল।
তারপর থেকে তারেক লন্ডনে, চিকিৎসায়। আগের চাইতে এখন খানিকটা সুস্থ। কিন্তু কোনোদিনই সম্পূর্ণ সুস্থ হবেন না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। সারাক্ষণই শরীরে যন্ত্রণা হয়। তার মেরুদণ্ডের ভেঙে যাওয়া হাড়টা জোড়া লেগেছে বাঁকা হয়ে।
ডাক্তাররা বলেছেন, সম্পূর্ণ আরোগ্য কখনওই সম্ভব নয়। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার ফিজিওথেরাপি নেন। আরও চিকিত্সা দরকার।
বেদনার্ত অতীতকে খুঁড়ে তুলতে, স্মরণে আনতে বিমর্ষ তারেকের বেশ অনীহা। তবু সম্প্রতি এক সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকাকালে আমার ওপর নানা রকমের দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক উপর থেকে বার বার ফেলে দেয়া।’
‘অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু ওইসব অফিসারের বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া হয়নি।ওদের দায়িত্ব ছিল আমাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় আমি কারাগারে। কোনো ডাক্তার নেই। চিকিৎসা হয়নি। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়।একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেপ্তার চলতে পারে। কিন্তু নির্যাতন করার, শরীরের অঙ্গ বিকল করার,মানবাধিকার পদদলিত করার অধিকার সভ্যতার কোথায় আছে?’
রিমাণ্ডের নামে তার ওপর চালানো হয় নির্মম, পৈশাচিক ও বর্বর নির্যাতন।তরতাজা যু্বককে করা হলো পঙ্গু।দীর্ঘ ১৮ মাস ধরে তাকে কারাগারে আটক রাখা হয়। নির্যাতনকে ধামাচাপা দিতে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী ২০০৭ সালের ২৫ আগস্ট খবর ছড়িয়ে দিল যে তারেক রহমান তার হাসপাতাল কক্ষে পা পিছলে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন। এরপর খবরের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয় ও ধারণা সৃষ্টি হয় যে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনকে গোপন করার লক্ষ্যে এই খবর ছড়ানো হয়।
এতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওই সময় বিক্ষোভ দেখা দেয়, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অথচ আসলেই খবরটা ছিল মইন ফখরুদ্দীনের একটি চাল মাত্র।
যা থেকে মানুষকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল তারেক রহমান কে কোনো রকম নির্যাতন করা হয়নি। কিন্তু ততদিনে দেশের মানুষ বুঝে গিয়েছিল শাসক গোষ্ঠী একজন তরতাজা টগবগে যুবক কে অকথ্য নির্যাতনের মাধ্যমে তার জীবনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সবগুলা মামলাই মিথ্যে প্রমাণিতত হয়ে ১৩ টি মামলাতেই জামিন পাওয়া পর দীর্ঘ ১৮ মাস পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। ১১ সেপ্টেম্বর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে চলে যান লন্ডনে চিকিৎসার জন্য। এখনও তিনি লন্ডনে চিকিৎসাধীন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। মেরুদণ্ডের ভেঙে যাওয়া হাড়টা জোড়া লেগেছে বাঁকা হয়ে। সেই ওয়ান ইলিভেন থেকেই শুরু হয় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার, যার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে বলে দাবি বিএনপির।
বর্তমানে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে অর্ধ শতাধিক মামলা ঝুলছে। তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন। বর্তমানে লন্ডনের সাউথ ওয়েলিংটন ও লন্ডন হসপিটালে তারেক রহমানের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসার সুবিধার্থে তিনি সেন্ট্রাল লন্ডনের এডমন্টনে সপরিবারে বাস করছেন।
প্রসঙ্গত, সরকার বিরোধী আন্দালনের মধ্যেই গেল ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো নির্বাসনে থাকাবস্থায় মারা যান। পরদিন কোকোর লাশ গুলশান অফিসে আনা হলে খালেদা জিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় ২৭ জানুয়ারি কোকোর লাশ দাফন করা হয়।
এছাড়া ২০০৯ সালের মে মাসে ৪০ বছরের স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি ছাড়া হয়ে উঠেছেন ভাড়া বাসায়। সেদিনও খালেদা জিয়া অঝোরে কেঁদেছেন খালেদা জিয়া।
এসব স্মৃতি বেগম খালেদা জিয়াকে আজও কাঁদায়। প্রতিবছর ছোট ছেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদেন বেগম জিয়া। এসব স্মৃতি যেন কোনোভাবেই ভুলে যাবার নয় খালেদা জিয়ার।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মায়ের দশম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। নামাজ পড়ে মায়ের জন্য দোয়া ছাড়া বিশেষ কোনো আয়োজন নেই।
তবে মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতেও ছাড় নেই খালেদা জিয়ার। জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী হওয়ায় আদালত মুলতবি চেয়ে করা আবেদন মঞ্জুর করেননি আদালত। কিন্তু শুধুমাত্র খালেদা জিয়াকে বৃহস্পতিবারের (১৮ জানুয়ারি) জন্য জামিন দেয় আদালত।
অন্য আসামিদের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শুনানি চলমান থাকবে বলেও জানান আদালত। তবে তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন এ জামিন গ্রহণ করেননি খালেদা জিয়া। তাই বৃহস্পতিবার নির্ধারিত যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শুনানিতে উপস্থিত হয়েছেন তিনি।
আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন জানান, খালেদা জিয়া শুনানির মুলতবি চেয়েছিলেন। তা মঞ্জুর না করে আদালত খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে ওই দিনের জন্য অব্যাহতি দেন। তিনি ব্যক্তিগত জামিন চাননি। তাই তিনি বৃহস্পতিবার আদালতে উপস্থিত হয়েছেন।
বুধবার আসামি শরফুদ্দিন আহমেদের পক্ষে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবী আহসানুল্লাহ। মামলার যুক্তিতর্ক ২ ঘণ্টা উপস্থাপন শেষে আদালত বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) পর্যন্ত মুলতবি করে। সরফুদ্দিন আহমেদের পক্ষে যুক্তি-তর্ক শেষ হলে অপেক্ষমান আছে অপর আসামি কাজী সালিমুল হক কামাল।
এর আগে খালেদা জিয়ার পক্ষে অ্যাডভোকেট আব্দুর রেজ্জাক খান, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার এজে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যুক্তি উত্থাপন করেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলা দু’টির প্রধান আসামি খালেদা জিয়া।
অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াসহ আসামি মোট ছয়জন। অন্য পাঁচ আসামি হলেন- বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।
আসামিদের মধ্যে ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক। বাকিরা জামিনে আছেন। এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন মোট ৩২ জন।
২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা করা হয়। মামলায় এতিমদের সহায়তা করার জন্য একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনে দুদক।
এদিকে বেগম খালেদা জিয়া নিজ বাসায় মায়ের মৃত্যুবাষির্কী পালন করবেন সাদামাটাভাবে। চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) প্রতিদিনের মতোে আদালত থেকে ফিরে মায়ের মৃত্যুবাষির্কীর দিনও নামাজ পড়ে মৃত মায়ের জন্য দোয়া করবেন।