মানুষের পাশে মাশরাফি

‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ বাংলাদেশে একজনই। মাশরাফি বিন মুর্তজা। দুই হাঁটুতে সাতবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। বোলিংয়ের ধার তাতে না কমলেও সতর্ক থাকতে গতিতে একটু লাগাম তো পরিয়েছেনই মাশরাফি। তবু গতিময় বোলিংয়ের কারণে ক্যারিয়ারের শুরুতেই পেয়ে যাওয়া খেতাবটি এখনো হারিয়ে যায়নি তাঁর নামের পাশ থেকে।

ওই ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ই এবার আবির্ভূত একটু অন্যভাবে। ক্রিকেটার মাশরাফির আরেকটি পরিচয় তিনি বিপদগ্রস্ত মানুষের বন্ধু। কারও নতুন দোকান করার পুঁজি নেই? আছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। অর্থের অভাবে কারও অস্ত্রোপচার হচ্ছে না? মাশরাফির সাহায্যের হাত পৌঁছে যায় সেখানেও। বিচ্ছিন্নভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়।

তবে এবার মাশরাফি মাঠে নেমেছেন আরও গুছিয়ে, আরও বড় উদ্দেশ্য নিয়ে। তাতে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ও হয়ে যাচ্ছে জনকল্যাণকর কাজের নতুন এক ‘ব্র্যান্ড নেম’। নিজ জেলা নড়াইলের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য জাতীয় দলের ওয়ানডে অধিনায়কের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন’।

কাগজে-কলমে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাশরাফি। তবে তিনি এটির আত্মপ্রকাশে এগিয়ে রাখেন অন্য উদ্যোক্তাদের, ‘এটা আসলে আমার একার কিছু নয়। আমার কয়েকজন বন্ধু এবং কিছু পরিচিত মানুষের ইচ্ছা ও চেষ্টাতেই এই সংগঠন। আমরা নড়াইলের মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থসামাজিক ও মানসিক উন্নতির জন্য কাজ করব।’

অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সংগঠন নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশনের অর্থের মূল জোগান এখন উদ্যোক্তারাই দিচ্ছেন। সঙ্গে জোগাড় করা হচ্ছে কিছু পৃষ্ঠপোষক। একটি কোমল পানীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যেমন আলোচনা চলছে, নড়াইল জেলায় বিক্রীত প্রতি বোতল পানি থেকে তারা ১ টাকা করে দেবে নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশনের তহবিলে।

গত ৪ সেপ্টেম্বর নড়াইল শহরে ‘রান ফর নড়াইল’-এর মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ সংগঠনটির। শহরের চৌরাস্তা এলাকায় এর কার্যালয়। ফাউন্ডেশন গঠনের উদ্দেশের কথা জানাতে গিয়ে মাশরাফি বলছিলেন, ‘নড়াইলবাসীর স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি, উন্নত নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত, শিক্ষায় সহযোগিতা, ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক ও মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা, বেকারত্ব দূরীকরণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি, খেলাধুলায় প্রশিক্ষণ ও চিত্রা নদীকে কেন্দ্র করে নড়াইলকে আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করবে ফাউন্ডেশন।’

এস এম সুলতান, রবি শংকর, উদয় শংকরদের জন্মস্থান নড়াইলকে নতুন প্রজন্মের বাসোপযোগী করে তুলতে চান তিনি, ‘আমরা চাই নড়াইলের নতুন প্রজন্মকে একটা সুস্থ-আধুনিক পরিবেশ দিতে। যাতে তারা নড়াইলে থাকে বা বাইরে গেলেও নড়াইলের জন্য তাদের টান থাকে। এখানে ফিরে আসে। পরিবেশ সুন্দর করলে, সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করলেই এটা সম্ভব।’

আত্মপ্রকাশের পর এই তিন মাসে জনকল্যাণে বেশ কিছু কাজ করেছে নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে সদর উপজেলার চালিতাতলা সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তৈরি করে দিয়েছে একটি বিজ্ঞান গবেষণাগার। শহরের কয়েকটি উন্মুক্ত স্থানে সুপেয় পানির ব্যবস্থার পাশাপাশি দুটি জায়গায় চালু করেছে বিনা মূল্যের ওয়াই-ফাই সুবিধা। তবে মাশরাফি জানিয়েছেন, এই ওয়াই-ফাই সবার জন্য নয়।

১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তারা এটি ব্যবহার করতে পারবে না। ওয়াই-ফাই ব্যবহার বিনা মূল্যে হলেও এর অপব্যবহার রোধে পাসওয়ার্ড ও কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য আইটি প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করছে ফাউন্ডেশন। নড়াইল শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে গতকাল ৩৫০ জন শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে হয়ে গেছে একটি কম্পিউটার কর্মশালা।

তাদের জনসেবামূলক কার্যক্রমে সর্বশেষ সংযোজন বিপিএলে মাশরাফির ফ্র্যাঞ্চাইজি রংপুর রাইডার্সের দেওয়া একটি অত্যাধুনিক অ্যাম্বুলেন্স। রংপুর রাইডার্সের মালিক বসুন্ধরা গ্রুপ। নড়াইলে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ অ্যাম্বুলেন্স নেই বললেই চলে। জরুরি চিকিৎসার জন্য ঢাকা বা খুলনা-যাত্রায় মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েন রোগীরা।

এটি ভেবেই মাশরাফি টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছে অনুরোধ করেছিলেন ফাউন্ডেশনকে একটি অ্যাম্বুলেন্স দিতে। তাঁর সে অনুরোধে সাড়া দিয়েই রংপুর রাইডার্সের পক্ষ থেকে ওই উপহার। অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নামমাত্র। জ্বালানি খরচ, চালকের বেতন আর অ্যাম্বুলেন্স রক্ষণাবেক্ষণে যা লাগে তাই।

সংগঠনের ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মাশরাফির মামা নাহিদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম, দুই যুগ্ম সম্পাদক কাজী বশিরুল হক ও এম এম কামরুল আলম এবং কোষাধ্যক্ষ মির্জা নজরুল ইসলাম।

তবে সবার জন্য সংগঠনের দরজা উন্মুক্ত। নড়াইলের যেকোনো মানুষ এখানে যেকোনো সমস্যা বা জনকল্যাণকর প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারবেন এখানে। মাশরাফির ভাষায়, ‘সংগঠন চালানোর জন্যই কমিটি করা। এটা নড়াইলের সব মানুষের জায়গা। যে কারও অধিকার আছে এখানে আসার, কথা বলার।’

মাশরাফির স্বপ্ন, পুরো নড়াইলকেই একদিন বদলে দেবে নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন। সেটি দেখে অন্য জেলা, অন্য শহরেও গড়ে উঠবে এমন সংগঠন। আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসবে সামর্থ্যবান মানুষ, গড়বে সোনার বাংলাদেশ। মাশরাফির স্বপ্ন সত্যি হলে নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন হতে পারে জনকল্যাণের নতুন এক চেতনা।

prothom-alo

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin