ভোটে যেতে খালেদার ছয় শর্ত

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ছয়টি শর্ত দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর হোটেল লা মেরিডিয়ানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রথম সভায় খালেদা জিয়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে শর্তগুলো তুলে ধরেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেছেন, মানুষ পরিবর্তন চায়। এই পরিবর্তন হতে হবে নির্বাচনের মাধ্যমে।

নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া শর্তগুলো হলো:

* ভোট হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে * জনগণকে ভোটকেন্দ্রে আসার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে * ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে * নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করতে হবে * ভোটের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে, সেনাবাহিনী মোবাইল ফোর্স হিসেবে কাজ করবে * যন্ত্রে ভোটের জন্য ইভিএম/ডিভিএম ব্যবহার করা যাবে না

সভার উদ্বোধনী বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, আমি যেখানেই থাকি না কেন আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে লাভ নেই। দলের নেতা ও এ দেশের মানুষের সঙ্গে আছি। তিনি দলের নেতাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ-প্রতিবাদ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ঐক্যবদ্ধ থাকতে নেতা কর্মীদের পরামর্শ দেন।

সভায় ছয় শর্ত দেওয়ার পর খালেদা জিয়া নির্বাহী কমিটির সদস্যদের কাছে জানতে চান তারা এর সঙ্গে একমত কি না। এ সময় নির্বাহী কমিটির সদস্যরা উচ্চ স্বরে বলেন একমত।

সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের প্রয়োজনে এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। তিনি দলের নেতাদের বলেন, একবার ক্ষমা করেছি। কিন্তু ক্ষমা বারবার করা যায় না। তাই দল ভাঙার যত চেষ্টাই হোক কেউ ফাঁদে পা দেবেন না। যারা দলের প্রতি অনুগত থাকবেন তাদের মূল্যায়ন করা হবে। যারা থাকবেন না তাদের আর ক্ষমা করা হবে না।

ধরপাকড়ের মধ্যে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভা

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় সামনে রেখে বিএনপির কর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি ও গ্রেপ্তার অব্যাহত আছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় আরও ১৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে ৪ দিনে ৪২৮ জনকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে। এ সময় পুলিশ বিএনপির দুই হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে আসামি করে মামলা করেছে।

নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় ও গ্রেপ্তার আতঙ্কের মধ্যে আজ শনিবার ঢাকায় জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা করছে বিএনপি। ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় সামনে রেখে এ সভা ডাকা হয়েছে। আজ সকাল ১০টায় বিমানবন্দর সড়কের লা মেরিডিয়ান হোটেলে এই সভা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

দলীয় সূত্র জানায়, সভায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের জন্য সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা ও চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেবেন। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দিতে পারেন। দলীয় একটি সূত্র জানায়, ৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের আগে সংক্ষিপ্ত সফরে খালেদা জিয়া সিলেটে যেতে পারেন। সেখানে তিনি হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করবেন।

বিএনপি অভিযোগ করেছে, নির্বাহী কমিটির সভায় সরকার বাধা সৃষ্টি করছে। গতকাল শুক্রবার সকালে সভার পরিচয়পত্র নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর নির্বাহী কমিটির বন ও পরিবেশবিষয়ক সহসম্পাদক কাজী রওনাকুল ইসলাম ও সদস্য মশিউর রহমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বিকেলে উত্তরা থেকে নির্বাহী কমিটির প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গত রাতে মহাখালী ডিওএইচএসে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা নাজিম উদ্দিন আলমের বাসা থেকে তাঁকে ও আমান উল্লাহ আমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদের মোহাম্মদপুরের বাসা অভিযান চালায়। তবে তিনি বাসায় ছিলেন না।

গত মঙ্গলবার খালেদা জিয়া আদালত থেকে ফেরার পথে পুলিশের ওপর হামলার পর থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় চলছে।

পুলিশের অভিযানের সমালোচনা করে গতকাল সকালে নয়াপল্টনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, যাতে নির্বাহী কমিটির সভা সাফল্যমণ্ডিত না হয়, সার্থক না হয়, এটাই সরকারের উদ্দেশ্য।

দলীয় সূত্র জানায়, আজকের সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার সভাপতিসহ প্রায় ৭০০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর মধ্যে অসুস্থতার কারণে এবং কারাগারে ও দেশের বাইরে থাকায় অনেকে সভায় থাকছেন না। গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় কেউ কেউ না আসতে পারেন।

বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটির ৩১০ জন পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন। অনেকে সরাসরি সভাস্থল থেকে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করবেন।

গ্রেপ্তার-তল্লাশি

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপির ১০ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। এ নিয়ে গত চার দিনে ঢাকায় ২৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। এর মধ্যে শাহবাগ থানার একটি মামলায় গতকাল গ্রেপ্তার পাঁচজনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

প্রথম আলোর যশোর অফিস জানায়, যশোর জেলার ৮টি থানায় ১৪টি মামলায় বিএনপির অন্তত এক হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ২৫০ জনের নাম-পরিচয় উল্লেখ করে এবং ৭৫০ জনকে অজ্ঞাত হিসেবে মামলায় এজাহারভুক্ত করা হয়েছে। গত বুধবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত এসব মামলা হয়। এর মধ্যে ৮১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এসব মামলায় বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে।

এর মধ্যে ‘নাশকতা পরিকল্পনার’ অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে কোতোয়ালি থানায় তিনটি মামলা হয়েছে বলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজমল হুদা প্রথম আলোকে বলেন।

এ ছাড়া গত তিন রাতে যশোরে বিএনপির ২০ নেতার বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। ছাত্রদলের যশোর পৌর কমিটির সভাপতি ফারুক হোসেনকে বাড়িতে না পেয়ে তাঁর ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে বলে পরিবার সূত্র জানায়।

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা জানান, গত দুই দিনে পুলিশ জেলার আটটি থানা থেকে বিএনপি-জামায়াতের ২৮ নেতা-কর্মীসহ ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নাশকতা, মাদকসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক (৫২) ও জেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শরীফুল ইসলামকে (৩৮) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার শেরপুর থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম (৫৫) ও থানা ছাত্রদলের সভাপতি আবদুর রাজ্জাককে (৩৫) গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ বলছে, তাঁরা গোপন বৈঠক করছিলেন।

নোয়াখালী অফিস জানায়, সোনাইমুড়ী উপজেলার আমিশাপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মো. রুবেলকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, রুবেলের কাছ থেকে একটি পাইপগান উদ্ধার করা হয়েছে।

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল বিকেলে জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোতালেব হোসেনসহ দলটির পাঁচ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরে গত ২৮ জানুয়ারি যৌথ কর্মিসভার সময় বিএনপির কর্মীদের লাঠিপেটা করে পুলিশ। ওই ঘটনায় বিএনপির ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করে। এরপর থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িতে থাকছেন না। বিএনপির কার্যালয়ও বন্ধ আছে।

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin