৮২ সাল থেকেই বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শুরু। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কিছু ‘বিশ্বস্ত অনুগামী’ বেছে নিয়েছিলেন। যাঁদের বলা হতো বেগম জিয়ার ‘কাছের মানুষ’। এদের পদ-পদবী যাই হোক খালেদা জিয়ার কাছে এদের প্রবেশাধিকার ছিল অবারিত। বেগম জিয়ার বিশ্বস্ত হিসেবে এদের ক্ষমতা এবং প্রভাব ছিল অনেক বেশি। কিন্তু বেগম জিয়া দু:সময়ে এই সব কাছের মানুষদের খবর নেই। তাঁরা থেকেও নেই। বেগম জিয়ার জন্য এদের কোনো সহানুভূতির প্রকাশও আমাদের নজরে আসেনি।
মোসাদ্দেক আলী ফালু বেগম জিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্তদের একজন হিসেবে পরিচিত। ফালু রাজনীতিতে আলোচিত হয়েছেন বেগম জিয়ার ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই। বেগম জিয়া রাজনীতিতে আসেন এক কঠিন সময়ে। এ সময় বিএনপিতে বিভক্তি আর কোন্দল। প্রায়ই এসব কোন্দল মারামারি আর সংঘর্ষে রূপ নিতো। এ সময়ই মির্জা আব্বাস নিয়ে আসেন মোসাদ্দেক আলী ফালুকে।
ফালু বেগম জিয়ার একান্ত সচিব কাম দেহরক্ষী হিসেবেই কাজ করেন দীর্ঘদিন। কাজ এবং বিশ্বাস দিয়ে তিনি বেগম জিয়ার আস্থা অর্জন করেন। ৮০’র দশকে ফালু ছিলেন বেগম জিয়ার সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী। ৯১ এ ক্ষমতায় এলে ফালুকে করা হয় একান্ত সচিব-১। এনিয়ে সেই সময় কম হৈ চৈ হয়নি। কিন্তু এসব সমালোচনাকে পাত্তা না দিয়ে বেগম জিয়া ফালুর ওপর নির্ভরতা বাড়াতেই থাকেন।
৯১ এ অনেক মন্ত্রীও ফালুকে খাতির করতো বেগম জিয়ার আনুকূল্য পাবার জন্য। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে বেগম জিয়াকে তারেকের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয়। এ সময় তারেক জিয়া হারিছ চৌধুরীকে পাঠান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাজনৈতিক সচিব-১ হিসেবে। মনখারাপ করে ফালু সরে যেতে উদ্যোগ নিলে বেগম জিয়া তাঁকে মান ভাঙান। আরও একটি রাজনৈতিক সচিবের পদ সৃষ্টি করে ফালুকেও কাছে রাখেন।
কিন্তু তারেকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ফালুর ‘রাজনৈতিক সচিব’ জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। এর মধ্যেই অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে বিকল্প ধারা নামে নতুন দল গঠন করেন। নতুন দলে যোগ দেন বিএনপির টিকেটে নির্বাচিত তেজগাঁও-রমনার এমপি মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান। ফালুকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সরাবার মোক্ষম অস্ত্র পান তারেক। উপ-নির্বাচনে তেজগাঁও -রমনার প্রার্থী বানান ফালুকে।
এরপরই বিএনপির রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েন ফালু। কিন্তু বেগম জিয়ার সঙ্গে ফালুর ব্যক্তিগত সম্পর্কে এতটুকু চিড় ধরেনি। বরং সৌদি আরবে ওমরাহ বা হজে ফালুই ছিলেন বেগম জিয়ার সঙ্গী। ওয়ান ইলেভেনে ফালু গ্রেপ্তার হন। এ সময় এনটিভি ভবনে আগুন লাগলে বেগম জিয়া নিজে সেখানে গিয়েছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে মোসাদ্দেক আলী ফালু অন্য মানুষ হয়ে যান।
তাঁর বিজনেস পার্টনার হন আওয়ামী লীগ নেতা এবং বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান। রাজনীতি বাদ দিয়ে ব্যবসায় মনোযোগ বেশি ফালুর। মাথায় বেশ কটা দুর্নীতির মামলা থাকলেও কিছুই স্পর্শ করে না তাঁকে। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা বলা হয় তাঁকে। ২০১৬ সালের কাউন্সিলে তাঁকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান করা হলে, তিনি পদত্যাগ পত্র পাঠান। কিন্তু সেই পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি।
বিএনপির ৩৬ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে ২১ তম মোসাদ্দেক আলী ফালু। তবে দলের কাজকর্মে তিনি নেই। বেগম জিয়া যখন কারাগারে তখন ফালুর নিস্পৃহতায় অবাক অনেকে। যার জন্য ‘বিজনেস টাইকুন’ হিসেবে ফালুর উত্থান, তিনিই ভুলে গেছেন বেগম জিয়াকে?
বেগম জিয়া রাজনীতিতে আসার পর যাঁদের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। বিএনপির অনেকেই বিশ্বাস করে, বেগম জিয়ার প্রশ্রয়েই ঢাকায় মির্জা আব্বাসের রাজত্বের অবসান হয়ে খোকার রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। ২০০১-০৬ সালে খোকা হয়েছিলেন বেগম জিয়ার টাকা বানানোর মেশিন। মন্ত্রিত্ব এবং মেয়র এক সঙ্গে উদযাপনে অদ্ভুত সুযোগ খোকা পেয়েছিলেন বেগম জিয়ার জন্যই।
খোকা বিএনপিতে কাউকে পাত্তা দিতেন না, যেকোনো বিষয়ে সরাসরি চলে যেতেন বেগম জিয়ার কাছে। ওয়ান ইলেভেন খোকার গ্রেপ্তার না হওয়াটা যেমন ছিল বিস্ময়কর, তারচেয়েও বিস্ময়কর ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তিন বছরের বেশি সময় বিনা নির্বাচনে অখণ্ড ঢাকার মেয়র থাকা। এতেও বেগম জিয়ার স্নেহ বঞ্চিত হননি খোকা। বরং ঢাকার জন্য খোকার দিকেই তাকিয়ে থাকতেন। এরপর খোকা চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
সেখানে তাঁর ক্যানসার চিকিৎসা চলছে। সর্বশেষ আলোচনায় ছিলেন নাগরিক ঐক্যের নেতা মান্নার সঙ্গে টেলিআলাপের জন্য। দুষ্ট লোকেরা বলে এই টেলি আলাপ খোকাই নাকি ফাঁস করেছিলেন। কাগজে কলমে খোকা বিএনপির ভাইসচেয়ারম্যান। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তারের পর একটা বিবৃতিও দেননি খোকা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা নেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত পছন্দে। দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব আর মুখ্য সচিব ছিলেন ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী। অনেকেই বলেন, রাষ্ট্রাচার এবং ফাইলপত্র কীভাবে দেখতে হয় তা বেগম জিয়াকে হাতে কলমে শিখিয়েছেন ড. কামাল সিদ্দিকী। তারেক মামুনের আপত্তিতে বেগম জিয়া অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেও ড. কামাল উদ্দিনকে বাদ দেননি।
দ্বিতীয় মেয়াদে বেগম জিয়ার পতনের পর ড. কামাল সিদ্দিকী বিদেশে পাড়ি জমান। বর্তমানে মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। জিয়া এতিম খানা মামলায় বেগম জিয়ার সঙ্গে তাঁরও ১০ বছরের জেল হলেও তিনি দেশে এসে আত্মসমর্পণ করেননি। আইনজীবীরা বলছেন, তাঁর একটি বক্তব্য পেলেই এই মামলায় বেগম জিয়া খালাস পেয়ে যেতেন।
ফান্ডের টাকার হাতবদল হয়েছে তাঁর স্বাক্ষরিত চেকে। বিএনপির আইনজীবীরা তাঁকে কয়েক দফা অনুরোধ করলেও, এই টাকা হস্তান্তরের সঙ্গে বেগম জিয়া জড়িত নন মর্মে জবানবন্দি দেননি এই আমলা। বেগম জিয়ার বিশ্বস্ত হলেও এখন তিনি বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য কিছুই করলেন না।
এরকম অনেক কাছের মানুষই এখন বেগম জিয়ার দু:সময়ে তাঁর থেকে দূরে।
ইলিয়াস আলী কি বেঁচে আছেন?
৬ বছর পর আবার আলোচনায় নিখোঁজ ইলিয়াস আলী। গত সোমবার ভোররাতে ডিবি পুলিশের একটি দল বনানীতে ইলিয়াস বাসভবনে অভিযান চালাতে যায়। কিন্তু নীচের দারোয়ান ‘সিলেট হাউসের’ গেট না খোলায় ভোর ৪টার দিকে সাদা পোশাকের লোকজন চলে যায়। ডিবি পুলিশ আসার খবর পেয়ে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদী লুনা, বিএনপির নেতাদের টেলিফোন করেন।
তিনি দারোয়ানকেও মূল গেট না খোলার জন্য নির্দেশ দেন। পরদিন, গতকাল মঙ্গলবার ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সহ বিএনপির শীর্ষ নেতারা ছুটে যান ইলিয়াস আলীর বাসভবনে, যেখানে তাঁরা ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।
ডিবির লোকজন সেখানে কেন গিয়েছিল, কিংবা আদৌ গিয়েছিল কিনা? এই প্রশ্নের পাশাপাশি, প্রশ্ন উঠেছে, তাঁর বাসায় কি এমন গুপ্তধন আছে যে ডিবি পুলিশ যাওয়া মাত্র অস্থির হয়ে উঠলেন ইলিয়াস আলীর স্ত্রী?
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল নিখোঁজ হন বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী। তাঁর গাড়ি পাওয়া যায় মহাখালীতে। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তাঁর ড্রাইভারও নিখোঁজ আছেন। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হবার পর থেকেই বিএনপি অভিযোগ করে আসছে ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী সেসময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেন।
প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার জন্য তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করার জন্য নির্দেশ দেবেন। কিন্তু গত ৬ বছরে ইলিয়াস আলীর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। বিএনপির অনেক নিখোঁজ নেতাকেই বিভিন্ন সময়ে মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে পাওয়া গেছে। বিএনপির আরেক নেতা সালাউদ্দিন আহমেদকে নিখোঁজ হওয়ার বেশ কিছুদিন পর ভারতে পাওয়া যায়।
অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্য এখন তিনি ভারতে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু ইলিয়াস আলীর ক্ষেত্রে এসব কিছুই ঘটেনি। তাঁর স্ত্রী সহ আত্মীয় স্বজন ধরেই নিয়েছেন তিনি আর নেই। কিন্তু একটা মানুষ যদি মারাও যায় তাঁর তো একটা ট্রেস পাওয়া যাবে। ইলিয়াস আলীর ক্ষেত্রে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। আবার একটা পরিবারের অভিভাবক চলে যাওয়ার পর ঐ পরিবারে যে পরিবর্তন, সেটাও ইলিয়াস আলীর পরিবারে দেখা যায়নি।
ইলিয়াস আলীর দুই ছেলেই লন্ডনে পড়াশুনা করছে। মেয়ে মায়ের সঙ্গে থাকে। গত ৬ বছরে ইলিয়াস আলীর পরিবারে কোনো দৈন্যতাও চোখে পড়েনি কারও। ইলিয়াস আলীর স্ত্রীও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়েছেন। তিনি এখন বিএনপির উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই ইলিয়াস আলীর বেঁচে থাকার নানা গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়ানো হয়।
ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান দিনে তার স্ত্রীও গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘তাঁর বিশ্বাস ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন। সত্যি কি ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন? রাজনৈতিক হয়রানির ভয়ে কি তিনি দেশের বাইরে কোথাও পালিয়ে আছেন? তার সঙ্গে কি পরিবারের যোগাযোগ আছে? তার ‘ সিলেট হাউজে’কি এমন কোনো আলামত আছে যেটা থেকে প্রমাণ করা সহজ হবে যে, ইলিয়াস আলী গুম হননি বরং সরকারকে বিব্রত করতেই এই গুম নাটক সাজানো হয়েছে?
সেই আলামতের সন্ধানেই কি ডিবি পুলিশ সোমবার রাতে ইলিয়াস আলীর বাড়িতে গিয়েছিলেন? একারণেই কি ইলিয়াস আলীর স্ত্রী লুনা বিষয়টিকে রাজনৈতিক অবয় দেওয়ার চেষ্টা করছেন? এজন্যই কি বিএনপির নেতারা পরদিন ছুটে গেছেন ঐ বাড়িতে? এসব কোনো প্রশ্নেরই উত্তর নেই। আর সে কারণেই ‘ইলিয়াস রহস্য’থেকেই যাচ্ছে রাজনীতির বিতর্কে।
বাংলা ইনসাইডার/