bnp-flag

বিএনপির সামনে কঠিন সমীকরণ

নির্ভুল রাজনৈতিক অঙ্ক কষে শেষ পর্যন্ত ফল ঘরে তুলতে পারা যাবে কি না—এমন প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বিএনপিতে। দলের নেতা এবং সমর্থক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ দেশে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনসমর্থন এখন আর একমাত্র নিয়ামক শক্তি নয়।

বরং দেশি-বিদেশি প্রভাবশালী মহলের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে সঠিক কর্মকৌশল প্রণয়নই এ ক্ষেত্রে মুখ্য। কিন্তু ওই কর্মকৌশল প্রণয়ন করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বিএনপি নিতে পারবে কি না সে আলোচনা দলীয় গণ্ডি পেরিয়ে সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যেও ছড়িয়েছে।

শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, আগের দুটি নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে সঠিক কর্মসূচি প্রণয়নে বিএনপিকে এবার অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দেশি-বিদেশি রাজনীতির যে ফ্যাক্টর বা সমীকরণ রয়েছে সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সমীকরণ বিবেচনায় নেওয়া বেশি জরুরি। ’

গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সামনে পথ কী আছে এই রাজনৈতিক সমীকরণ সঠিকভাবে না কষতে পারলে বিএনপির কপালে দুঃখ আছে। তাঁর মতে, এবারে ‘আমলা-কামলা’দের পরামর্শ বেশি গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ‘গতবার তাঁদের কথায় বিএনপির অনেক ভুল হয়েছে। তা ছাড়া খালেদা জিয়া মাঠে আছেন, তাঁকে মাঠে থাকতে হবে।

বিশ্রাম নিলে চলবে না। তবে জনগণ সঙ্গে আছে এবং তারা পরিবর্তন চায়—এই সুযোগ বিএনপি নেবে কি না সেই হিসাব বিএনপিকেই করতে হবে। ’
দলীয় সূত্রে জানা যায়, এবারও বিএনপি পারবে কি না—এমন আলোচনার কারণ এক-এগারোর পর অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির কর্মকৌশল।

ওই কৌশল ভুল ছিল বলে মনে করা হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচন হতো না বা পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতো বলে এখনো অনেকে মনে করেন।

বিএনপির বড় একটি অংশের মতে, ওই পরিস্থিতিতে তৃতীয় বা অন্য কোনো শক্তি ক্ষমতায় এলেও এখনকার মতো এতটা ক্ষতিগ্রস্ত বিএনপি নাও হতে পারত। আবার জনমতের যে অবস্থা ছিল তাতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে ফল ভালো হতে পারত বলে মনে করা হয়। কারণ ওই সময় ঢাকা ছাড়া দেশের বেশির ভাগ নির্বাচনী এলাকা বিএনপির নিয়ন্ত্রণে ছিল।

অনেকের মতে, ওই দুটি নির্বাচনের একটিতে বিএনপিকে ‘নেওয়ার ফাঁদে’ এবং অন্যটিতে ‘বাইরে রাখার ফাঁদে’ ফেলা হয়েছিল। দলটির নীতিনির্ধারকরা সেটি বুঝতে সক্ষম হননি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলটির বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ নেতা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন যে নির্বাচন হবে না।

ফলে তাঁরা নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে অটল থেকে সে অনুযায়ী কর্মকৌশল ঠিক করেছেন। বিএনপি নেতাদের কাছে পরে স্পষ্ট হয়েছে, ওই সময় দেশি-বিদেশি কিছু শক্তির ভূমিকায় বিএনপি যেমন বিভ্রান্ত হয়েছে, তেমনি দেশের ভেতরের কোনো কোনো শক্তি বিভ্রান্তিকর খবর দিয়ে দলটিকে নির্বাচনে না যাওয়ার দিকেও ঠেলে দিয়েছে।

এ অবস্থায় এবারও বিএনপি আন্তর্জাতিক কোনো শক্তিকে বিশ্বাস করে কর্মকৌশল নির্ধারণ করবে, নাকি তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হবে—সে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি বিএনপি আগের মতো বিভ্রান্ত হবে, নাকি নিজেদের কৌশল ব্যবহার করে পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে পারবে—এমন প্রশ্ন দলটির নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলছে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনেও বিএনপির কৌশলগত ভুল ছিল বলে মনে করেন দলের ও সমর্থক মহলের কেউ কেউ। ওই সময় দেশের বেশির ভাগ এলাকা বিএনপির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ঢাকা মহানগরীতে দলটির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। অন্যদিকে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকারী নেতারাও পরিস্থিতি অনকূলে নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানগত সমীকরণ বুঝতে না পারার সীমাবদ্ধতা দলটিকে ভুল পথে নিয়ে গেছে। আগামী নির্বাচনের আগেও বিএনপি বহিঃশক্তিগুলোর ওই সমীকরণ সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হবে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে।

অভিযোগ আছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সব গোপন খবর সরকারের কাছে আগাম চলে যেত। সে কারণে ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে যেতে বাধার মুখে পড়েছিলেন। দপ্তর সম্পাদক অসুস্থ (আসলে অসুস্থ ছিলেন না) রিজভী আহমেদকে দেখতে যাওয়ার কথা বলে খালেদা জিয়ার ওই সময় নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে অবস্থান নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।

কিন্তু ওই পরিকল্পনা গোয়েন্দা সংস্থা আগেই জেনে গিয়েছিল। আর তাত্ক্ষণিকভাবে গুলশান কার্যালয় ঘিরে ফেলেছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে খালেদা জিয়া আর নয়াপল্টনে যেতে পারেননি। তাঁকে গুলশানে নিজ কার্যালয়েই অবস্থান নিতে হয়। বিএনপির বেশির ভাগ নেতাই মনে করেন, নয়াপল্টনে খালেদা জিয়া অবস্থান নিতে পারলে আন্দোলনের মোড় ঘুরে যেত।

কারণ নয়াপল্টনে চারদিকে থেকে নেতাকর্মীদের বেরোনোর বা ঢোকার সুযোগ ছিল, যেটি গুলশানে কূটনৈতিক পাড়ায় ছিল না। ফলে শুধু খালেদা জিয়াকে গুলশানে তাঁর কার্যালয়ে আটকে রেখেই সরকার ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

পর্যবেক্ষকমহলের পাশাপাশি বিএনপিরও একটি বড় অংশের ধারণা, আগামী নির্বাচনের আগেও বিএনপিকে আবার ফাঁদে ফেলা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব আসাও অসম্ভব নয়। গত নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাব দিলেও বিএনপির করণীয় আগে থেকে ঠিক না থাকায় খালেদা জিয়া অনেকটা উষ্মার সঙ্গে জবাব দিয়েছিলেন।

পরে সেটি প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। গণমাধ্যমের বদৌলতে অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে সরকার প্রস্তাব দিলেও বিএনপিই তা প্রত্যাখ্যান করেছে অর্থাৎ বিএনপিই তখন সমঝোতা চায়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ওই প্রস্তাবও বিএনপির অনেক নেতার কাছে এখনো ‘ফাঁদ’ বলেই বিবেচিত। এবারও বিএনপি ফাঁদে পড়বে, নাকি সঠিক কর্মকৌশল ঠিক করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে—সে প্রশ্ন উঠছে দল তথা সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মনে করেন, জনগণ যেভাবে সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ তাতে আন্দোলন ও নির্বাচন দুটির ফলই বিএনপির পক্ষে যাবে। কিন্তু সরকার ইচ্ছা করে যদি নির্বাচেন যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে সেটিও জনগণ দেখবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলা হয়, সে ক্ষেত্রে বিএনপি গত দুটি নির্বাচনে ভুল করেনি।

বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষণও বদলায়। এখন হয়তো অনেকে মনে করতে পারেন ওই দুটি নির্বাচনে বিএনপি ভুল করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা কি নিশ্চিত যে বিএনপি গত নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করলেও তা ঘোষণা করা হতো?’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি নয় যে সরকারের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করবে। বিএনপির কাজ হলো সুষ্ঠু নির্বাচন তথা গণতন্ত্রের পক্ষে জনগণকে সংগঠিত করা, যা আমরা করছি। ’ তাঁর মতে, রাজনৈতিক দলের কর্মকৌশল কার্যকর করার সঙ্গে সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার সম্পর্ক রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ক্ষমতায় বসে সরকার গণতন্ত্র চর্চার বদলে ফ্যাসিস্ট আচরণ করলে সেখানে কর্মকৌশল কার্যকর হবে কিভাবে? তবে সরকার গণতন্ত্রের পথে থাকলে অবশ্যই বিএনপির কর্মকৌশল কার্যকর হবে। কারণ জনগণ বিএনপির সঙ্গে আছে। ’

দলীয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়টি কিছুটা বিবেচনায় থাকলেও সামগ্রিক করণীয় নিয়ে বিএনপি এখনো চিন্তা শুরু করেনি। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দাবি মানা না হলে বিএনপি কী করবে, এমন প্রশ্নে করণীয় সম্পর্কে দলটি মন স্থির করেনি। যদিও এ নিয়ে বিএনপির মধ্যে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।

বিএনপির নেতাদের ধারণা, সরকারের একটি অংশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে অটল থাকলেও সমঝোতা তথা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষেও সরকারের মধ্যে একাংশ রয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত সমাধানের একটি পথ বেরিয়ে আসতে পারে বলে তাঁরা মনে করেন। আবার সমাধান না হলে বিএনপির করণীয় নিয়ে দলে দুই ধরনের মত রয়েছে বলে জানা যায়।

একটি অংশ মনে করে, জনমতের যে অবস্থা তাতে ন্যূনতম কিছু দাবি আদায় করে শেখ হাসিনার অধীন নির্বাচনে গেলেও বিএনপির জয় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। এ ছাড়া পরবর্তী নির্বাচনে না গেলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও এ অংশটি মনে করে। ফলে যেকোনো মূল্যে তারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে। অন্যদিকে আরেকটি অংশ মনে করে, শেখ হাসিনার অধীন নির্বাচনে গেলে ফল যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।

ফলে শেখ হাসিনার অধীন নির্বাচনে না গিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে যাওয়ার পক্ষে ওই অংশের নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি কোন দিকে যাবে সেই হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে না গেলে বিএনপির আবার হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে থাকা কয়েকটি দলের নেতারাও।

বিকল্পধারার সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী মনে করেন, সঠিক কর্মকৌশল প্রণয়ন করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য বিএনপিকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তিনি বলেন, প্রথমত বিদেশিদের মতামত পক্ষে আনার মতো তৎপর ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন নেতা দরকার, যেটির ঘাটতি এখন বিএনপিতে রয়েছে।

দ্বিতীয়ত বিএনপিতে ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র থাকায় কর্মকৌশল প্রণয়নের ক্ষেত্রে সেটি এখনো বড় বাধা। ক্ষমতার একটি কেন্দ্র হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুবিধা হতো। তিনি আরো বলেন, সবচেয়ে বড় কথা সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোকে বিএনপি এখনো বন্ধু বানাতে পারেনি। ফলে কত দূর তারা যেতে পারবে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের মতে, আগের দুটি নির্বাচনের আগে বিএনপি সব কিছু সঠিকভাবে সামাল দিতে পারেনি, এর অর্থ এই নয় যে ভবিষ্যতেও পারবে না। তিনি বলেন, ‘মানুষ ভুল থেকে শিক্ষা নেয় এবং সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী কর্মকৌশল নির্ধারণ করে। আমি মনে করি, এবার বিএনপিও তা-ই করবে। ’

কালের কণ্ঠ

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin