বিএনপির লক্ষ লোকের সমাবেশ : তারপর কি

গত শনিবার ১ সেপ্টেম্বর ৪১ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে নয়া পল্টনে বিএনপির যে জনসভা হয়ে গেল সেটা যারা সরেজমিনে দেখেছেন অথবা টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় ফটো দেখেছেন তাদের সকলের মধ্যে দেখা গেছে বিস্ময়।

কারণ জনসভায় হাজির হয়েছিল হাজার হাজার নয়, কয়েক লক্ষ মানুষ। এই যে লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে কোনো ভাড়াটিয়া মানুষ দেখা যায়নি। তাদের প্রতিপক্ষ যখন সোহরাওয়ার্দীতে জনসভা করে তখন শত শত বাস-ট্রাক বোঝাই করে ভাড়াটিয়া মানুষ এনেও সভার একটি কোণাও পূর্ণ হয় না।

আমাদের দেশে জনসভার আকর্ষণ হচ্ছে নেতা বা নেত্রীর বিশাল ইমেজ। নেতার টানেই হাজার হাজার মানুষ জনসভায় ছুটে যায়। আবার দেখা যায়, অন্য কোনো দলের সভায় যখন সেই রকম খ্যাতিমান কোনো ব্যক্তি নেতা তালিকায় না থাকেন তখন সাধারণ মানুষ বলে, দূর, কার বক্তৃতা শুনতে যাবো?

আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টি যদি মিটিং করে তাহলে তাদের স্টার বক্তা থাকেন যথাক্রমে শেখ হাসিনা ও জেনারেল এরশাদ। অনুরূপভাবে বিএনপির জনসভার স্টার নেতা-বক্তা ৬ মাস আগে পর্যন্ত ছিলেন খালেদা জিয়া; অতীতে ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।

পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলে আওয়ামী লীগের তারকা নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর তারকা হিসেবে উত্থিত হন শেখ হাসিনা। মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে স্টার পরিচিতি পান জেনারেল জিয়াউর রহমান। তারপর তারকা হিসেবে উত্থিত হন তার পত্মি বেগম খালেদা জিয়া।

গত শনিবার নয়া পল্টনে বিএনপির যে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয় সেই জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন না। তারপরেও জনসভায় লক্ষ লক্ষ লোক সমাগম হয়েছে। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী কাকরাইল মোড়ের নাইটেঙ্গেল থেকে শুরু করে ফকিরাপুল ছাড়িয়ে আরামবাগ পর্যন্ত রাস্তা লোকে লোকারণ্য ছিলো। এমনকি রাস্তার ওপরেও লোক সংকুলান হচ্ছিলো না।

তাই মানুষ গলির মধ্যেও ঢুকে পড়ে। এত লোক, অথচ কোনো স্টার লিডার নাই, নাই কোনো স্টার স্পিকার। ফখরুল, খন্দকার মোশারফ, গয়েশ্বর প্রমুখ নেতা আর যাই হোক, মেঠো বক্তৃতার জন্য তাদের নাম ডাক নাই। বক্তা হিসেবে শেখ মুজিবের পর আসম আব্দুর রব এবং মাহমুদুর রহমান মান্না অনেক নাম করেন। ইংরেজিতে বলা হয়, Flamboyant Orator অর্থাৎ অগ্নিঝরা বক্তা। তাদের বক্তৃতায় প্রকাশ হতো আগুণের হল্কা।

কিন্তু এরকম একজন বক্তাও বিএনপিতে নাই। যে মঞ্চে খালেদা জিয়া বক্তৃতা করবেন না সেই জনসভায় তার পরেও লক্ষ লক্ষ জনের সমাবেশ ঘটলো কেন? এই বিষয়টিই মনে হয় সরকার মোটেই আমলে নিচ্ছে না। এছাড়া সেখানে কোনো ভাড়াটিয়া লোক নাই। তারপরেও এত লোক আসে কোত্থেকে? এটিই যদি সরকার একবার ভাবত তাহলে বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক সমস্যার সমাধন হয়ে যেতো।

সোজা কথা হলো, মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। চারিদিকে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। মানুষ যদি অন্তত মুক্ত মনে কথা বলতে পারতো, খোলামেলা কলম চালাতে পারতো, মিটিং করতে পারতো, সভা করতে পারতো, সম্মেলন করতে পারতো তাহলেও হয়তো এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। একারণেই মানুষ এই গুমোট পরিস্থিতির অবসান চায়।

যেখানে অর্ধ সহস্রাধিক লোক গুম হয়ে গেছে, যাদের আর খবর কেউ পায় না, তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে, সেটি কেউ জানে না এমন একটা পরিস্থিতিতে সুস্থ স্বাভাবিক রাজনীতি কি আর থাকে? এটি আমার কথা নয়। আপনি আপনার পরিচিত যে কারো সাথে রাজনীতি নিয়ে কথা বলুন, কথা বলুন সরকারের বিরুদ্ধে, এমনকি সেটি যদি হয় টেলিফোনেও তাহলে অপর প্রান্ত সাথে সাথে বলবেন, ভাই নো পলিটিক্স। অন্য কথা বলুন।

কারণ সকলেরই ভয়, এই বুঝি টেলিফোনের কথা রেকর্ড হচ্ছে। এই বুঝি রাত তিনটায় আপনার দরজায় এসে কেউ করাঘাত করবে। এটিকেই বলা হয় ত্রাসের রাজত্ব। এই অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি চায়।

দুই

মুক্তি চাইলেও কিন্তু মানুষ সহিংসতার আশ্রয় নেয়নি। সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়নি। গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক পথেই মানুষ পরিবর্তন চায়। কিন্তু সেই পরিবর্তনটা তো আসতে হবে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি ক্রিয়াশীল হবে রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। ছোট ছোট দল যত ভালো কথাই বলুক না কেন, মানুষ বলে যে এরাতো আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না।

সুতরাং তাদের পেছনে জড়ো হয়ে কোনো লাভ নাই। মানুষ তাদের পেছনে জড়ো হচ্ছে যাদেরকে লোকে মনে করে যে, এরা ক্ষমতায় যেতে পারে। এখানে আমি একটি কথা খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই। বিএনপির মিটিংয়ে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ যায় তারা সকলেই যে বিএনপির সাপোর্টার সেটা সত্য নয়। কিন্তু এখন যারা পরিবর্তন চায়, যারা চায় ১০ বছরের শাসনের অবসান ঘটুক, তারাও এখন বিএনপিকে সমর্থন করছে। এটিকেই বলা হয় নেগেটিভ ভোট বা নেতিবাচক সমর্থন।

আমার মনে হয়, সরকার একটি বিষয় বুঝতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সেটা হলো কোনো দলের কোনো কর্মী বা সমর্থক চায় না যে তাদের শীর্ষ নেতানেত্রী অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দী থাকুক। শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করে যখন জেল দেওয়া হয় তখন সমর্থকরা মনে করে যে তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। তারা আরো মনে করে যে, আইনি প্রক্রিয়ায় নেতা বা নেত্রীকে জেল থেকে বের করা যাবে না।

রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে জেল থেকে বের করে আনতে হবে। আমাদের এই বক্তব্যের জ¦লন্ত উদাহরণ হলো শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। সব সময় বলা হয়েছে, এটি একটি মিথ্যা মামলা। কিন্তু পরবর্তীতে মামলার অন্যতম আসামী কর্নেল শওকত আলীসহ অনেক জাঁদরেল আওয়ামী লীগার বলেছেন, সেটি ছিলো সত্য মামলা। এখন তো সরকারিভাবেই বলা হচ্ছে, সেটি ছিলো একটি সত্য মামলা।

এখন আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, আন্দোলন করে বেগম জিয়াকে জেল থেকে বের করা যাবে না। তাকে জেল থেকে বের করতে হলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বের করতে হবে। আর বিএনপির এক শ্রেণির নেতা বলছেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেগম জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়। রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করে আনতে হবে।

সেই সময় আওয়ামী লীগ স্লোগান দিতো, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো,’ ‘ঘেরাও করো ক্যান্টনমেন্ট, মুক্ত করো শেখ মুজিব।’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এই ধরনের স্লোগান দেওয়া এবং রাজপথে আন্দোলন ও পুলিশের সাথে ঢিলা ঢিলি করার রাজনীতি আওয়ামী লীগই শিখিয়েছে। এখন তারা ক্ষমতায় যাওয়ার পর ঐ ধরনের রাজনীতিকে সন্ত্রাসী তৎপরতা, সহিংসতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিরোধিতা বলে আখ্যায়িত করছে।

মানুষ অতীতে যে ধরনের রাজনীতি শিখেছে সেই ধরনের রাজনীতি অনুসরণ করেই তারা বিএনপির পেছনে জড়ো হয়েছে। হাটে-মাঠে-ঘাটে যদি শেখ মুজিবের মুক্তির স্লোগান উচ্চকণ্ঠে ধ্বনিত না হতো তাহলে শেখ মুজিবের মুক্তি আন্দোলন তত জোরদার হতো না। সেই কাজটিই করতে চাচ্ছে বিএনপি। কিন্তু পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

কোনো তারকা নেতা বা তারকা বক্তা ছাড়াই বিএনপির জনসভা জনসমুদ্রে রূপান্তরিত হওয়া এই বার্তাই দিচ্ছে যে, মানুষ এখন আর নেতা দেখছে না। তারা দেখছে দল। বেগম জিয়াকে গ্রেফতারের ফলে দলের নেতাকর্মীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং দিনের পর দিন সেই ঐক্যকে জোরদার করছেন।

তিন

এত সব কথা বলার পরেও কিন্তু একটি বিরাট প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। বেগম জিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, বিএনপি ডাক দিলেই রাস্তায় মানুষ উপচে পড়ছে। সেটা মানববন্ধন হোক, অনশন হোক আর জনসভা হোক। গত ৬ মাস থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, বিএনপি যদি শুধুমাত্র ডাক দেয় তাহলেই হাজার হাজার লোক এসে হাজির হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যেসব লোক বিএনপির সভা-সমাবেশে হাজির হচ্ছে তারা কিন্তু প্রধানত বিএনপিরই সমর্থক। ২০ দলীয় জোটের নামে বিএনপি কোনো জনসভা আহবান করেছে বলে আমার জানা নাই। যদি ২০ দলীয় জোটের উদ্যোগে জনসভা আহবান করা হলে শুধু মাত্র বিএনপির সমর্থকরাই আসবে না, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট প্রভৃতি দলের সমর্থকরাও সেই জনসভায় জমায়েত হবে। কারো হয়তো লোকবল কম, কারো হয়তো বেশি। কিন্তু এখন বিএনপির জনসভা যতো বড় হচ্ছে ২০ দলীয় জোটও যদি তাদের সমর্থক নিয়ে সেই জনসভায় হাজির হয় তাহলে সেই জনসভার কলেবর আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে।

চার

এখন একটি প্রাসঙ্গিক এবং গুরুতর প্রশ্ন। প্রতিটি সভাতেই হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক আসছে, তালি দিচ্ছে, স্লোগান দিচ্ছে এবং তারপর ঘরে ফিরে যাচ্ছে। আর বক্তারাও সরকারের দুঃশাসন, অপশাসন, ফ্যাসিবাদী জুলুম ইত্যাদি বর্ণনা করে যাচ্ছেন। তারপর তারাও ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। ফল কি দাঁড়াচ্ছে? বেগম জিয়া কি মুক্তি পাচ্ছেন? গণতন্ত্র কি মুক্তি পাচ্ছে? এসবের কিছুই হচ্ছে না। কারণ মিটিংয়ের পরে কোনো ফলো আপ নাই। বলা হচ্ছে যে, ডিসেম্বরের শেষদিকে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেক্ষেত্রে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করতেই হবে। তফসিল ঘোষণার পর নেতাদের হাতে সময় খুবই কম থাকবে। এর মধ্যে তারা কবে কর্মসূচী দেবেন, আর কবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন? এটা বিএনপির কি ধরনের রাজনীতি সেটি আমার বোধগম্য নয়। ২০০৪ সাল থেকে তো বিএনপি নেতাদের মুখে একই কথা শুনে আসছি। বলা যেতে পারে, চর্বিত চর্বন। আওয়ামী লীগ সরকার এটা করেছে, সেটা করেছে। এই ধরনের অনেক দুঃশাসন এবং অপশাসনের কথা মানুষের হৃদ মাঝারে যেমন প্রোথিত হয়েছে তেমনি শুনতে শুনতে তাদের কান অর্ধেক ঝালাপালা হয়ে গেছে। এখন মানুষ আর ঐসব বক্তৃতা শুনতে চায় না। মানুষ চায় এ্যাকশন বা কাজ। এর পরেও যদি মাঠে কোনো কিছু না হয় তাহলে সেটা হবে বহ্বাড়াম্বরে লঘু ক্রিয়া

উৎসঃ   ইনকিলাব

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin