bnp-flag

বিএনপির নেতৃত্বের অন্দরে কী ঘটছে?

মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে যেন জর্জরিত হয়ে পড়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতৃত্ব। একটি অংশ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে তো আরেকটি অংশ কোণঠাসা হয়ে মেতে থাকছে দলেরই সমালোচনায়। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

অবিশ্বাস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কারও কারও কপালে ‘সরকারের দালাল’ তকমাও জুটে যাচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের অনুসারী পরিচয়ে দুটি অংশই এ দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে বলে আলোচনা দলীয় মহলে।

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলটির পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন লন্ডনে বসবাসরত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের হাতে। তিনি দল পরিচালনায় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন বলে পরিচিত জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকটাই উপেক্ষা করছেন বলে অভিযোগ শোনা যায়।

এরই ধারাবাহিকতায় তারেক রহমানের অনুসারী পরিচয়ধারী নেতাদের কাছে খালেদার অনুসারী নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

এর মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদক হিসেবে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সকে।

তিনি ১/১১ এর সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত হওয়ায় এ নিয়েও নানা মুখরোচক আলোচনা ছড়ায় রাজনৈতিক মহলে।

রিজভী আহমেদ দফতরের দায়িত্বে থাকাবস্থায় ‘লন্ডনের ক্ষমতাবলে’ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন বিধায় এ পদে প্রিন্সকে বসানোর ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ নেতাদের একাংশের প্রভাবের কথা ছড়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে। এমনকি রিজভী আর দফতরে ফিরতে পারবেন কি-না, সে আলোচনাও ছড়িয়ে দেয়া হয়।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, দুর্নীতি মামলায় কারাদণ্ডিত খালেদা জিয়া গত মার্চে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পাওয়ার পর দুই ঈদের দুদিন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, চিকিৎসক ও আইনজীবী ছাড়া কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি।

যে নেতাদের সাক্ষাৎ দিয়েছেন, দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অভিমত তুলে ধরেছেন তিনি। দল পরিচালনায় কিছু ভুল পদক্ষেপ চিহ্নিত করে তা সমাধানেরও নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। কিন্তু নানা অজুহাতে এবং তারেক রহমানের প্রভাবের কারণে সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের দাবি, খালেদা জিয়ার মতামত উপেক্ষা করেই বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। তাছাড়া নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হচ্ছে দলের বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ নেতাকে। বিএনপির সব সিদ্ধান্ত এখন একাই নিচ্ছেন তারেক রহমান। তার বাইরে কিছু বলতে বা করতে পারছেন না মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও।

দলের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তারেক রহমান সবার সঙ্গে কথা বলেন প্রচার থাকলেও কার্যত একাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি। এক্ষেত্রে তার পছন্দের দু-একজন নেতার পরামর্শকে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন, যে নেতাদের কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি নেই।

পুরোনো নেতাদের এড়িয়ে নব্বইয়ের দশকের ছাত্রদল নেতাদের দিয়ে দল পুনর্গঠনে মনোযোগ দিয়েছেন তারেক। এ সুযোগে তাকে সামনে রেখে নিজস্ব বলয় গড়ে তুলছেন দলের দু-তিনজন কেন্দ্রীয় নেতা।

দলের আরেকটি সূত্র জানায়, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে যে হাওয়া ভবন তৈরি হয়েছিল, যেটিকে কেন্দ্র করে এখনো রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা, সেই ভবনের কর্মচারীরাও এখন দলের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। হাস্যোজ্জ্বলে অনেকে বলেন, হাওয়া ভবনের কর্মচারীদের যে ক্ষমতা, তার সিকিভাগও নেই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের।

খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে সাংগঠনিক নানা ধরনের কাজ করাতেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের মাধ্যমে। খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত এ নেতা দলীয় অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে রাখতেন চেয়ারপারসনের চাহিদা অনুযায়ী।

প্রচার আছে, দল গোছানোর ক্ষেত্রে তিনি সব বলয়ের প্রভাবমুক্ত থেকে খালেদা জিয়ার আস্থা অর্জন করেছিলেন। তারেক রহমানের প্রভাবের কারণে এখন আর তিনি সে অবস্থানে নেই।

কিছু নেতার অভিযোগ, অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে বাদ রেখে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে দলের স্থায়ী কমিটিতে স্থান দিয়েছেন তারেক রহমান। কারণ এ দুজনই তার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত।

অন্যদিকে তাদের চেয়ে সিনিয়র ও ত্যাগী নেতারা অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও মেজর (অব.) ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর দলের অনেক বিষয়েই বিভিন্ন মিডিয়ায় কথা বলেছেন।

আবার আবদুল্লাহ আল নোমানসহ অনেকে কোনো কথা না বলে একেবারেই চুপ করে আছেন। রাজনীতিতেও সক্রিয় হচ্ছেন না। তারা যেন অনেকটাই রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছেন।

এর সুবাদে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন তারেক রহমানের অনুসারী পরিচয়ধারীরা। তারা অনেক সময়ই জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে আঁতাতের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। ফলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি গঠনে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতামতের কোনো তোয়াক্কাই করা হয় না।

এমনকি জ্যেষ্ঠ নেতাদের জেলাগুলোতে দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের কমিটি হচ্ছে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ও মতামতের তোয়াক্কা না করে। এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে অঙ্গ সংগঠনের নেতারা তারেক রহমানের নির্দেশে কাজ করছেন বলে জানান।

দলের শীর্ষ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তারেক সাহেব এখন আর জ্যেষ্ঠদের এবং খালেদা জিয়ার আস্থাভাজনদের গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বরং তিনি ১/১১ এর সংস্কারপন্থী ও হাওয়া ভবনের দুর্নীতিবাজদের নিয়ে দল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। তিনি অবশ্য তারুণ্যকেও প্রাধান্য দিচ্ছেন।

তবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বগুণ এবং নেতা নির্বাচন পদ্ধতিতে কোনো পক্ষই বেশি বিক্ষুব্ধ থাকত না। সবাইকে ম্যানেজ করেই দল পরিচালনায় গুরুত্ব দিতেন চেয়ারপারসন। কিন্তু তারেক রহমানের ‘ড্যাম কেয়ার’ নীতি বিএনপিকে খাদের কিনারে দাঁড় করাবে।’

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘তারেক রহমান তার নিজ জেলা বগুড়ায় তিন দফা কমিটি ঘোষণা করেও বিক্ষোভ এড়াতে পারেননি। বগুড়ার সবক’টি কমিটি গঠনের পর পার্টি অফিসে তালা মারার ঘটনা ঘটেছে। এখন যিনি দফতরের দায়িত্বে আছেন তিনিও একজন সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত।

তারেক রহমান মনে করেন, জ্যেষ্ঠ নেতারা তাকে মেনে রাজনীতি করবেন না। সুতরাং তাদের গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। বরং কৌশলে তাদের নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে যা করার দরকার তাই করা হচ্ছে। ফলে তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেই তার সমর্থকরা সমালোচককে ‘সরকারের দালাল’সহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করতে কুণ্ঠিত হন না।

বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে বিভক্তির কথা স্পষ্ট হয় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্যে। তিনি সম্প্রতি বলেন, খালেদা জিয়া তার আশপাশে ‘সিনসিয়ার’ ও ‘রেসপন্সিবল’ নেতা তৈরি করতে পারেননি।

বিএনপি এখন খণ্ড-বিখণ্ড দল বলেও দাবি করেন তিনি।

যদিও এর জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়া তার আশপাশে ‘সিনসিয়ার’ ও ‘রেসপন্সিবল’ নেতা তৈরি করতে পারেননি, এটা একদম মিথ্যা কথা। এর কোনো ভিত্তি নেই। বরং বিএনপি এখন ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, এভাবে অবিশ্বাস-দ্বন্দ্ব চলতে থাকলে বিএনপি আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না।

জাগো নিউজ

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin