বিএনপির কাছে জামায়াতই উত্তম!

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পৃথক প্রার্থী দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনে ‘ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীরা’ শর্ত আরোপ করলেও ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের সঙ্গে আপাতত সম্পর্ক ভাঙার দিকে যাচ্ছে না বিএনপি।

দলটির প্রধান কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়া সিনিয়র নেতাদের কাছে এমন বার্তাই পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে। ঈদুল আজহার দিনে তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে দলের নেতাদের জানিয়েছেন দল ও জোট ঠিক রেখে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়তে।

বিএনপি অনেক দিন ধরেই ÿমতাসীন দল ও এর জোটের বাইরে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনে কাজ করে আসছে। এজন্য দলটি অনেক কিছুই ছাড় দিতেও রাজি আছে। তবে যাদের নিয়ে এই বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠন করা হবে, তাদের অর্থাৎ বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট, ড. কামালের গণফোরাম ও কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ বিএনপির জাতীয় ঐক্যে শরিক হতে তাদের জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগ করার শর্ত দিয়ে আসছে।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আলাদা প্রার্থী দেওয়ার পর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির একটি দূরত্বও তৈরি হয়েছিল। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন যে, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার বোধহয় সময় হলো বিএনপির। দলটির ভেতরকার ও সহমর্মী বুদ্ধিজীবীদের জামায়াতবিরোধী গ্রæপটি এ নিয়ে বেশ খুশিও হয়েছিলেন। কিন্তু অবশেষে তা আর হলো না।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আলাদা প্রার্থী দিলেও সেখানে আরিফুলের জয়লাভের পেছনে জামায়াতের একটি পরোÿ অবদান দেখছে বিএনপি। জামায়াতের নেতাকর্মীদের দৃঢ় অবস্থানের কারণে ÿমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লোকরা সেখানকার অনেক কেন্দ্র দখলে যেতে না পারায় তা বিএনপির প্রার্থীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। অন্যদিকে জামায়াতকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, বিএনপি ছাড়া ‘তোমরা এতিম’। জামায়াতও এখন আগের অবস্থান থেকে একটু সরে এসেছে বলে মনে হয়। তাছাড়া রাজনীতির ময়দানে বি. চৌধুরী, ড. কামালদের গুরুত্ব থাকলেও ভোটের হিসাব-নিকাশের পাল্লায় বিএনপির কাছে জামায়াতই বরং ভারী। সেই হিসেবেও জামায়াতের সঙ্গ এখনই ত্যাগ করতে চায় না বিএনপি।

এদিকে জামায়াতের বিষয়টি ফয়সালা না করেই আসন্ন একাদশ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট ও বিএনপি অভিন্ন ইস্যুতে মাঠে নামতে পারে। এ লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করতে কাজ করছে উভয় পক্ষ। আর শিগগিরই আন্দোলন, নির্বাচন এবং আসন সমঝোতা বিষয়েও আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসবেন উভয় দলের নেতারা। যুক্তফ্রন্ট ও বিএনপির একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছেন।

সুষ্ঠু নির্বাচন দাবিতে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে মাঠে নামবে নতুন এই জোট। অন্যদিকে যুক্তফ্রন্টের একাধিক সূত্র জানায়, অভিন্ন ইস্যুতে যুক্তফ্রন্ট ও বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেবে। তবে খোদ যুক্তফ্রন্টেই এখনো জট কাটেনি। ড. কামাল হোসেন ও বি. চৌধুরী একসঙ্গে কাজ করতে একমত হলেও এ ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রধান বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী।

এদিকে গণফোরামকে নিয়ে যুক্তফ্রন্টের জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। আজকে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত এ কারণে যে, এই জাতীয় ঐক্যের প্রক্রিয়া অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে।

প্রায় দেড় দশক ধরে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর ২৮ আগস্ট এই ফ্রন্টের সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। তবে বৃহত্তর ঐক্য গঠনে এদের সঙ্গে এখনো বিএনপির আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক হয়নি। যুক্তফ্রন্ট নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে পৃথক আলোচনা হলেও জোটগতভাবে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন জানিয়েছেন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে শিগগিরই বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হবে। আর গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানিয়েছেন, জাতির ক্রান্তিলগ্নে ড. কামাল হোসেন ও অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী একসঙ্গে কাজ করতে একমত হয়েছেন।

২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিকল্পধারা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও নাগরিক ঐক্য এই তিন দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান করা হয় বি. চৌধুরীকে। ওই বৈঠকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ উপস্থিত থাকলেও পরে কাদের সিদ্দিকীকে আর যুক্তফ্রন্টের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়নি।

এক বছরের বেশি সময় বিভিন্ন বৈঠকে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্টে যোগদান থেকে বিরত থাকে ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম। প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দিলেও একাই চলেছেন ড. কামাল হোসেন। তবে কিছু দিন আগে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেন তিনি।

এদিকে ৩০ আগস্ট মতিঝিল গণফোরাম কার্যালয়ের এক বৈঠকে ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে সাড়া দেননি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ-প্রধান বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী। ঘণ্টাখানেকের এ বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা দুজনের কেউই খোলাসা করেননি।

তবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের মহাসচিব হাবিবুর রহমান তালুকদার জানিয়েছেন, দুই নেতা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং তাদের রাজনৈতিক অবস্থান বিষয়ে আলাপ করেন। এ সময় ড. কামাল হোসেন ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে আহ্বান জানান। কিন্তু কাদের সিদ্দিকী তার আহ্বানে সাড়া দেননি। এ ব্যাপারে তিনি দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন। তবে ড. কামাল হোসেনের যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে সমঝোতাকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। একই সঙ্গে বলেছেন আপাতত তিনি ঐক্য প্রক্রিয়া কিংবা যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন না।

নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে রাজনীতির ময়দানে ক্ষমতাসীন বিরোধী একটি বৃহত্তর ঐক্য গঠনের তোড়জোড়ও ততই লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে এখনই এই ঐক্য তেমন করে স্পষ্ট হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তফসিল ঘোষণার পরই এসব বিষয় পুরোপুরিভাবে দৃশ্যমান হবে।

বাছির জামাল: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin