bnp-flag

বিএনপিতে স্বস্তির আড়ালে আতঙ্ক

বিএনপিগত অক্টোবর থেকে নভেম্বরে মাত্র ২৬ দিনের মধ্যে তিনটি কর্মসূচিতে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সাড়া দেখে অনেকটাই স্বস্তিতে আছে বিএনপি। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দলীয় ও জোটের তিনটি বৈঠকেও বিষয়টি উঠে আসে। তবে স্বস্তির পাশাপাশি বিএনপি ও জোটের প্রায় সব নেতার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা থাকায় দুশ্চিন্তাও কাজ করছে সমানভাবে। এক্ষেত্রে শীর্ষনেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য করাসহ নানা আতঙ্ক বিরাজ করছে বিএনপি ও জোট নেতাদের মধ্যে।

জোটের কোনও কোনও শরিক নেতা মনে করেন, বিএনপিকে আইনিভাবে ও রাজপথে মামলাগুলোর বিষয়ে সমাধান করা উচিত। তাদের পরামর্শ, বিএনপিকে রাজপথের সমাধানেই বিশ্বাস রাখা প্রয়োজন।

বিএনপি ও জোট নেতাদের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, মামলা নিয়ে সরকারের আতঙ্ক ছড়ানোর কৌশল থাকলেও পাল্টা কৌশল বিএনপিতেও আছে। এক্ষেত্রে দুটি সম্ভাবনাকে সামনে রেখে আগামী দিনের রাজনৈতিক রণকৌশল নির্ধারণ করতে চান দলটির নীতিনির্ধাকরা। সে লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন দলটির নেতারা। এই কাজে যুক্ত আছেন কয়েকজন বুদ্ধিজীবীও।

বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৮ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর, এই ২৬ দিনে তিনটি কর্মসূচি আয়োজন এবং এর ফলে দলীয় নেতাকর্মীরা যেমন চাঙা হয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিপুল সাড়া পড়েছে। ১৮ অক্টোবর খালেদা জিয়ার দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে বিমানবন্দরে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি, ২৮ অক্টোবর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাত্রাকালে মানুষের সাড়া এবং ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশে নেতাকর্মী ও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের বিষয়টি আন্দোলিত করেছে বিএনপি ও দলটির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে।

তিনটি অনুষ্ঠানের সাফল্য নিয়ে নেতারা ‍উচ্ছ্বসিত হয়েছেন খালেদা জিয়ার সামনেও। ১৫ নভেম্বর রাতে ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে শরিক দলগুলোর শীর্ষনেতারা, ১৮ নভেম্বর রাতে বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যানরা এবং ২২ নভেম্বর দলের উপদেষ্টারা চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠকে ওই তিন কর্মসূচিতে জমায়েত প্রসঙ্গে স্বস্তি প্রকাশ করেন।

১৮ নভেম্বর বৈঠক শেষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু এ প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, ‘পরপর তিনটি প্রোগ্রাম সফল হয়েছে। আমরা ম্যাডামের সামনে বিষয়টি তুলে ধরেছি।’ জোটের বৈঠকে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা ইসহাকসহ অন্য নেতারা তিনটি অনুষ্ঠানের সাফল্য ধরে রাখতে আগামীতে আরও বেশি গণসংযোগের পরামর্শ দেন।

সূত্রমতে, দল ও জোটে এই প্রশংসা থাকলেও আড়ালে মামলা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের। দলের শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল–সর্বস্তরেই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য মামলা।

মামলার বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান বলেন, ‘ ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে মঈন-ফখরুদ্দীনের সময়ের দুটি, বাকিগুলো এই সরকারের দুই টার্মে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও জানান, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে রয়েছে ৮৫টি মামলা। এরমধ্যে একটি মামলায় খালাস দেওয়া হয়েছে। ওই মামলার বাদী ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। বর্তমানে ২৫টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। কয়েকটা মামলা স্থগিত রয়েছে। আর সারাদেশে লাখো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা তো রয়েছেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি জনপ্রিয় দল, খালেদা জিয়া দেশের জনপ্রিয়তম রাজনীতিক। ফলে কর্মসূচিতে মানুষের সাড়া পড়বে, এটা খুব স্বাভাবিক।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যে মামলাগুলো রয়েছে, আমরা আইনি পথেই তা মোকাবিলা করব।’

মামলা নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা নেই বলে দাবি করেন সাবেক এই স্বাস্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কোনও দুশ্চিন্তা নেই। মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। ম্যাডামের শাস্তি হলেও এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতই হবে। আমরা আইনি পথে মোকাবিলা করব। রাজনৈতিকভাবেও মোকাবিলা করব।’

তবে এসব ইস্যুতে আন্দোলনের পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপি-জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাপ-এর মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া। তিনি বলেন, ‘তিনটি প্রোগ্রাম করার পর হয়তো বিএনপি আশা করছে সরকার অনেকটা নমনীয়। বিদেশি বন্ধু ও দাতাগোষ্ঠীর চাপে সরকার একটা সময় আপস করতে বাধ্য হবে। বিএনপি পরিস্থিতি আইনগতভাবে মোকাবিলা করবে বলেই আমার মনে হয়। তবে, আমি মনে করি আন্দোলন ছাড়া কোনও বিকল্প নাই। রাজপথে জিততে না পারলে অন্য কোথাও জেতা খুব সম্ভব নয়।’ রাজপথের আন্দোলনে বিজয়ী হতে পারলেই বিদেশি বন্ধুরা পাশে দাঁড়াবে– এমনটিই মনে করেন গোলাম মোস্তফা।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের প্রথম সহসভাপতি এজমল হোসেন পাইলট মনে করেন, জনগণের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে সুড়ঙ্গের মধ্যে একটু আলো দেখছিল বিএনপি। তিনি বলেন, ‘যদি জনগণের বিপুল সম্পৃক্ততা না দেখা যেত, তাহলে তো দল হিসেবে বিএনপি আরও তোপের মুখে পড়ে যেত।’

তিনি আরও বলেন, ‘ দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের মামলাগুলো মোকাবিলা করা হবে আইনিভাবেই। আর রাজনৈতিক মামলা সবসময়ই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।’

ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদে বলেন, ‘রাষ্ট্রের সবকিছু নষ্ট হলে এই রকমই হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে আবারও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করতে সেই মামলাগুলোকে সচল করছেন। এগুলো এক-এগারোর সময়কার মামলা। আমরা শঙ্কিত নই, আমরা যারা ছাত্রদল করি, মামলাগুলো ফায়সালা রাজপথেই করব বলে বিশ্বাস করি।’

তরুণ নেতা ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদল যুগ্ম সম্পাদক এস. এম সায়মন কবীর শাওনের দাবি, মামলা থাকলেও তাদের মধ্যে এ নিয়ে তেমন আতঙ্ক নেই। বিশেষ করে পরপর তিনটি সফল প্রোগ্রাম করে ব্যাপক জনসমর্থনের উপস্থিতি ঘটাতে পেরে দলের নেতাকর্মীরা অনেকটাই উজ্জীবিত। শাওন বলেন, ‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের মিথ্যা মামলা রাজপথেই সমাধান হবে বলে আমরা বিশ্বাস রাখি।’

জানতে চাইলে বিএনপি-ঘনিষ্ঠ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘তিনটি সফল আয়োজন করে কিছুটা আত্মতুষ্টিতে আছে বিএনপি, এটা হওয়ার যুক্তিও আছে। কিন্তু তিনি (খালেদা জিয়ার) বিশ্রামের সময় বেশি নিচ্ছেন। তার উচিত, দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আসা।’

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, মামলা দিয়ে বিএনপিকে আটকানোর চেষ্টা করা হলেও দলটির রয়েছে ভিন্ন পরিকল্পনা। প্রণীত হচ্ছে ভিন্ন রাজনৈতিক রণকৌশল। সূত্রের ভাষ্য, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটো চিন্তাকে এগিয়ে রাখছে বিএনপি। একটি হচ্ছে, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে বিএনপির সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আওয়ামী লীগ ও েদলটির নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে বাকি দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। এক্ষেত্রে নির্বাচনি জোট বা সমঝোতাভিত্তিক কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত, যদি আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে না গিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করতে চায়, সেক্ষেত্রে বিএনপিও চায়, দলটি একতরফা নির্বাচন করুক।

ওই সূত্রের যুক্তি, আওয়ামী লীগ আরও একবার একতরফা নির্বাচনের দিকে গেলে রাজনৈতিকভাবেই দলটির ভবিষ্যৎ শঙ্কার মধ্যে পড়বে। তবে এই ধারণাকে বাস্তব করতে হলে নির্বাচন থেকে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে হবে। বিএনপির একাধিক নেতা ও জাতীয়বাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা এই চেষ্টা সফল করার উদ্যোগ শুরু করেছেন।

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পরামর্শ, ‘বিএনপিকে জনমুখী কর্মসূচি নিয়ে আরও উদ্যোগী হওয়া উচিত। দরকার ছিল হরতালে আরও আগে সমর্থন দেওয়া। অন্য দলগুলোর সঙ্গে বসে রাজনৈতিকভাবে আগামী নির্বাচন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’ এ প্রসঙ্গে বিএনপির কোনও নেতা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা আরও অপেক্ষা করার পক্ষে মত দিয়েছেন।

বাংলা ট্রিবিউন

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin