রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় গুঞ্জন হলো, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কি বিএনপি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন? তিনি কি ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটানোর কাজ করবেন? গত কয়েকদিনের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ যারা পর্যবেক্ষন করছেন, তাঁরা এসব প্রশ্ন তুলছেন।
আর এই গুঞ্জনের সূত্রপাত হয়, রাজনৈতিক দলের ইফতার পার্টিতে বিএনপি মহাসচিব এবং অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বক্তব্য থেকে। ওই ইফতার পার্টির আয়োজক ছিলো বিএনপি। সেখানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অধ্যাপক চৌধুরীকে জাতির অভিভাবক এবং ‘উজ্জ্বল নক্ষত্র’ বলেন।
অধ্যাপক বি. চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তির উত্থানের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। পরবর্তীতে যোগাযোগ করা হলে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বলেন ‘আমি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে রাজনীতিতে একটি তৃতীয় শক্তির কথা বলেছি।’
এনিয়ে কয়েকদিন বিএনপিতে ক্ষোভ অসন্তোষ থাকলেও পরে তা স্তিমিত হয়ে যায়। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু গত দুই দিনে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একাধিক টেলি আলাপ এবং সাক্ষাতের পর এই গুঞ্জন আরও বেড়েছে।
অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলছেন ‘আমি এবং ড.কামাল হোসেন একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছি যেখানে আমরা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছি। আমরা সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহবান জানিয়েছি।’
অধ্যাপক চৌধুরী বলেন ‘ বাংলাদেশে এখন একটি জাতীয় শক্তি অত্যন্ত জরুরী। আর এই জাতীয় শক্তিতে আওয়ামী লীগ বিএনপি যে কেউ আসতে পারে।’ তবে ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই তৃতীয় শক্তিতে যোগ দেবেন কিনা, সেব্যাপারে এখনই কোন মন্তব্য
করতে রাজি হননি এই প্রবীণ রাজনীতিবীদ। তবে, অধ্যাপক চৌধুরী স্বীকার করেছেন যে, বিএনপির মহাসচিব একজন নমনীয়, মার্জিত মানুষ। তার সংগে নিয়মিত যোগাযোগ আছে বলেও জানিয়েছেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি।
বিএনপির একাধিক নেতার সংগে যোগাযোগ করা হলে, তারা জানান যে, অধ্যাপক বদরুজ্জোদা চৌধুরীর সংগে মির্জা ফখরুলের সম্পর্ক পুরনো। তারা বলেন, মির্জা ফখরুল যে তৃতীয় ধারায় যেতে পারেন তার অনেকগুলো ইঙ্গিতই পাওয়া গেছে।
একজন নেতা বললেন, বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হবার পর মির্জা ফখরুল ড: কামাল হোসেনের চেম্বারে গিয়ে তাঁর সংগে সাক্ষাত করেন। সে সময় বিএনপি মহাসচিব বলেছিলেন, এতিম খানা দুর্নীতি মামলার রায় নিয়ে কথা বলতেই সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ মামলায় ড: কামাল হোসেন এখন পর্যন্ত সম্পৃক্ত হননি। আরেক নেতা জানালেন, মির্জা ফখরুল অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে ড: কামাল সেখানে ছুটে যান।
বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হবার পর ২০ দলীয় জোটের ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিবের অনাগ্রহ দৃশ্যমান। তিনি নিজেই সমন্বয়কের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। জামাতের ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিবের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথা সকলেই জানে বলেও বিএনপির অনেক নেতা জানিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বললেন, বেগম জিয়া দণ্ডিত হবার পর দায়িত্ব নেন মির্জা ফখরুল। দায়িত্ব নিয়েই তিনি সংস্কারপন্থীদের সামনে আনেন। লে. জে. অবসরপ্রাপ্ত মাহবুব কিংবা মেজর (অব.) হাফিজের মতো সংস্কারপন্থীদের তিনি কাছে টেনে নিয়েছেন।
আর এইসব কিছু যোগ করলে দেখা যায়, বিএনপিতে থেকেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলাদা। তাঁর কথাবার্তাও ড: কামাল হোসেনদের ঘরানার। তিনি নিজেও জানেন, বিএনপি পাল্টে ফেলার ক্ষমতা তাঁর নেই। তাই কি তিনি নিজেই চলে যাবেন তৃতীয় ধারায়?
‘আপনাদের নূন্যতম আইনের জ্ঞান নেই’
বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে তাঁর আইনজীবীরা সিরিয়াস নন বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া। তারেক জিয়া বেগম জিয়ার জন্য নিযুক্ত ব্রিটিশ আইনজীবীর সঙ্গে দীর্ঘ পরামর্শের পর এই অভিযোগ করেছেন। দুমাস আগে তারেক জিয়া ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড কারলাইলকে বেগম জিয়ার সব মামলার আইনী পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেন।
ঢাকায় আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, সব মামলার কাগজপত্র লন্ডনে পাঠাতে হবে। সেখানে লর্ড কারলাইন কাগজপত্র নিরীক্ষা করে বলেছেন, বিএনপির আইনজীবীরা ভুল পথে এগুচ্ছে। মামলাগুলো জামিনের আবেদনের বদলে সবগুলো মামলার কোয়াশমেন্ট (বাতিল) পিটিশন করা উচিৎ ছিলো।
ব্রিটিশ আইনজীবী মনে করেন, মামলাগুলো বাতিলের আবেদন করে জামিন চাইলেই কেবল উচ্চ আদালত জামিন বিবেচনা করত। এখন উচ্চতর আদালতে যেভাবে জামিন চাওয়া হয়েছে, তাতে হাইকোর্ট সরাসরি এটি নিম্ন আদালতে শুনানির নির্দেশ দেবে বলেই ব্রিটিশ আইনজীবী মনে করেন।
তিনি জানিয়েছেন, এতে কালক্ষেপণ হবে। বেগম জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত হবে। গতরাতে তারেক এইসব বিষয় নিয়ে তার দলের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে তারেক জিয়া তাঁদের আইনি জ্ঞান নিয়েও সন্দেহ করেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ৯ মে বেগম জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় আপিল বিভাগ থেকে জামিন পান। কিন্তু আরো ৭টি মামলায় গ্রেপ্তারী পরোয়ানা থাকায় বেগম জিয়া এখন জেলে। লন্ডন থেকে লর্ড কারলাইল সবগুলো মামলা একসঙ্গে হাইকোর্টে নিষ্পত্তির পরামর্শ দিলে, ২১ মে হাইকোর্টে ৪ মামলার জামিনের আবেদন করা হয়।
বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি জে বি এম হাসানের ডিভিশন বেঞ্চে ইতিমধ্যে দু’টি মামলার (কুমিল্লার হত্যা ও নাশকতার মামলা) শুনানি হয়েছে। কিন্তু শুধু জামিনের আবেদন করার প্রেক্ষিতে বেগম জিয়ার ব্রিটিশ পরামর্শক আইনজীবি অবাক হয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিম্ন আদালতে শুনানী ছাড়া উচ্চ আদালত জামিন দেয় এখনই যখন মামলাটি সরাসরি বাতিলের আবেদন করা হয়। কিন্তু আইনজীবীরা তা করেননি।
বেগম জিয়ার ব্রিটিশ পরামর্শক মনে করছেন, এটাও একটা ভুল কৌশল। পরে তারেক তার দলের আইনজীবীদের জিজ্ঞেস করলেন,‘ আপনাদের কি আইনের নূন্যতম জ্ঞান নেই? এভাবে কি আম্মা মুক্তি পাবে? অবশ্য বেগম জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, এরকম জামিন দেয়ার এখতিয়ার হাইকোর্টের আছে। এর আগে নুরুল ইসলাম বাবুলের মামলায় হাইকোর্ট এভাবে জামিন দিয়েছিল।
আগামী রোববার এ ব্যাপারে হাইকোর্ট আদেশ দিতে পারে।
বাংলা ইনসাইডার