ফখরুল আউট, সিঁথি ইন

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কর্তৃত্ব খর্ব করা হলো। এখন থেকে বিএনপির সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রয়াত কোকোর স্ত্রী সৈয়দ শর্মিলা রহমান সিঁথির পরামর্শ নিতে হবে। গতকাল শুক্রবার লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া বিএনপি মহাসচিবকে টেলিফোন করে এই নির্দেশনা দেন। টেলিফোনের নির্দেশ পেয়েই মির্জা ফখরুল ছুটে যান গুলশানে, বেগম জিয়ার বাসভবনে।

কোকোর স্ত্রী তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে এই বাসভবনেই উঠেছেন। এখানে প্রায় ১৫ মিনিট একান্তে কথা বলেন মির্জা ফখরুল। এরপর সেখানে আসেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। সংশ্লিষ্ট সূত্র গুলো বলছে, সিঁথি আন্দোলনের চেয়ে বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য দলকে কাজ করার নির্দেশ দেন। সিঁথি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আপনাদের আন্দোলনে মা মুক্তি পাবে না। আমরা ওনাকে জেল থেকে বের করার চেষ্টা করছি। আপনি আমাদের সহযোগিতা করেন।’ মির্জা ফখরুল তাঁর কথার সঙ্গে সায় দেন।

৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বেগম জিয়া তাঁর পুত্র তারেক জিয়ার হাতে বিএনপি তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু লন্ডনে থাকায় তিনি বিএনপির নেতৃত্ব ঠিকমতো দিতে পারেননি। তাঁর কথাতে বিএনপির নেতৃবৃন্দ উজ্জীবিত ও হতে পারেননি।

আর একারণেই বিএনপির নেতৃত্ব দিতে লন্ডন থেকে শর্মিলা রহমানকে পাঠানো হয়েছে। তবে বেগম জিয়ার পারিবারিক সূত্র বলছে, দল চালাতে নয়, সিঁথি মূলত: ঢাকায় এসেছেন বেগম জিয়ার মুক্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে। বিএনপির কোনো নেতা যেন বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক খেলা খেলতে না পারে সে কারণেই মির্জা ফখরুলকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। এর ফলে ফখরুলের ৫৮ দিনের বিএনপিতে রাজত্ব শেষ হলো।

মওদুদের সঙ্গে দেখা করলেন না শর্মিলা

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের সঙ্গে দেখা করলেন না শর্মিলা রহমান সিঁথি। দারোয়ানকে দিয়ে জানিয়ে দিলেন, ‘এখন ব্যস্ত, দেখা হবে না।’ এর দুই ঘণ্টা পরই বিকেল ৫ টায় দেখা করলেন বেগম জিয়ার আরেক আইনজীবী এ জেড মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। ঘটনাটি আজ রোববারের।

লন্ডন থেকে বেগম জিয়ার চিকিৎসার সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র এনেছেন প্রয়াত কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান। এই সব কাগজপত্র বেগম জিয়ার অসুস্থতার প্রমাণ। এই মেডিকেল রিপোর্টে আগামী মে মাসে বেগম জিয়াকে আবার চিকিৎসক দেখবেন বলে বলা হয়েছিল। রোববার সকালেই শর্মিলা ডাক্তারি কাগজপত্রগুলো তাঁর কাছ থেকে নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীকে পাঠাতে বলেন।

টেলিফোনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে এই অনুরোধ করেন সিঁথি। রিজভী সঙ্গে সঙ্গেই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উদ্দিন খোকনকে টেলিফোনে একথা জানান। খোকনের সিনিয়র ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। খোকন বিষয়টি মওদুদকে অবহিত করেন। ব্যারিস্টার মওদুদ মাহাবুব উদ্দিন খোকনকে বলেন, ‘আমি গুলশানের দিকেই আছি।

আমিই দেখা করে কাগজগুলো নেবো।’ ব্যারিস্টার মওদুদ বিকেল ৩ টা নাগাদ গুলশানে শর্মিলা রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু শর্মিলা দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর রিজভী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আলীকে কাগজগুলো সংগ্রহের অনুরোধ করেন। বিকেল ৫ টায় গিয়ে মোহাম্মদ আলী শর্মিলার কাছ থেকে কাগজগুলো গ্রহণ করেন।

ফখরুলকে ছাড়া নেতাদের সঙ্গে শর্মিলার বৈঠক

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বাদ দিয়ে তিন নেতার সঙ্গে বৈঠক করলেন সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি। গতকাল শনিবার রাতে গুলশানে বাসভবনে শর্মিলা বিএনপির তিন নেতাকে ডেকে পাঠান। এরা হলেন মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান এবং ড: আবদুল মঈন খান। রাত আটা থেকে সাড়ে নটা পর্যন্ত ওই তিন নেতা প্রয়াত কোকোর স্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন। যদিও বৈঠক সম্পর্কে তিন নেতাই বলেছেন, ‘এটা সৌজন্য সাক্ষাৎ। বহুদিন পর তিনি এসেছেন, এজন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।’

বৈঠকে বিএনপি মহাসচিবের না থাকা প্রসঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা জানারেন ‘এটা কোনো বৈঠক না, তাছাড়া মহাসচিব শুক্রবারই ওনার সঙ্গে দেখা করেছেন।’ কিন্তু অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, কোকোর স্ত্রী তিন নেতাকে দলে আরও সক্রিয় হবার পরামর্শ দিয়েছেন। দলের মহাসচিব যেন একা সিদ্ধান্ত না নেন, সে ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র গুলো বলছে, শর্মিলা রহমান আন্দোলনের কি কি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আসন্ন দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ব্যাপারে তিন নেতার মনোভাব জানতে চেয়েছেন। তবে এসব ব্যাপারে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত বা মতামত দেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন নেতা বলেছেন ‘যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালনার বার্তা দিয়েছেন শর্মিলা। এর ফলে মহাসচিব এখন একক কর্তৃত্ব দল চালাতে পারবেন না।’

ফখরুলকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বললেন খালেদা

বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ বেগম জিয়ার তীব্র আপত্তির মুখেই মাঝপথ থেকে ফিরে যান মির্জা ফখরুল। শুক্রবার বেগম জিয়া তাঁর পুত্রবধূ এবং বোনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতে তিনি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে মন্তব্য করেন। এজন্যই তিনি তাঁর পরিবারকে দলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। বেগম জিয়ার পরিবার এবং কারা সূত্রে এ খবর পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বেগম জিয়া মনে করছেন, সিনিয়র নেতারা তাঁর সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করছেন। সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করে, ওই নেতারা শুধু নিজেদের জন্য সুবিধা আদায় করছেন। বেগম জিয়া এটাও মনে করেন, সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং আইনজীবীদের জন্যই তাঁর কারাবাস দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ কারণেই, তাঁর পরিবারের সদস্যদের দিয়েই বিএনপি পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন দুর্নীতির অভিযোগে দন্ডিত বেগম খালেদা জিয়া।

জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠরা বলেছেন, বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হবার পরপরই তাঁর মুক্তির জন্য সমঝোতার উদ্যোগ নেন শামীম ইস্কান্দার। এই সমঝোতা প্রক্রিয়া অনেকদূর এগুনোর পর হঠাৎ এর সঙ্গে যুক্ত হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং আরও কয়েকজন সিনিয়র নেতা। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ।

তারা বেগম জিয়ার মুক্তির সঙ্গে নির্বাচন এবং আসন ভাগাভাগি পর্যন্ত যুক্ত করা শুরু করে।  জিয়া পরিবারের দাবি, ব্যক্তিগত লাভের আশায় এরা মুক্তি প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, একপর্যায়ে শামীম ইস্কান্দারকে পাশ কাটিয়ে মির্জা ফখরুলই যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কারাগারে থাকলেও এই খবর ঠিক পৌঁছে বেগম জিয়ার কাছে।

সূত্রমতে, সমঝোতার খুটিনাটি চূড়ান্ত করতে মির্জা ফখরুল বৃহস্পতিবার নাজিমউদ্দিন রোডে বন্দী বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের আবেদন করেন। এই সাক্ষাতের ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব দলকেও অন্ধকারে রাখেন। দলের নেতাদের তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন।’ কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখনই যখন বেগম জিয়া জানতে পারেন যে, মির্জা ফখরুল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। তিনি ফখরুলের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান। এরপরই অসুস্থতার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।

জেল সূত্রে জানা গেছে, বেগম জিয়ার আগ্রহেই শুক্রবার প্রয়াত কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। শর্মিলাকে তিনি তাঁর (বেগম জিয়ার) মুক্তির সঙ্গে অন্য কিছু না জড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি শুধু উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, কবে তিনি দেশে ফিরতে চান তাও উহ্য রাখতে চান। শুধু এটুকু বলতে চান, ‘যতদিন তাঁর চিকিৎসা চলবে ততদিন তিনি বিদেশে অবস্থান করবেন।

বেগম জিয়া এখনই নির্বাচনের ব্যাপারে হ্যাঁ বা না কিছু বলতে রাজি নয়। মূলত এই বিষয়গুলো নিয়েই বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ। একাধিক সূত্র বলছে, বেগম জিয়া বলেছেন, নির্বাচনে যাওয়া বা না যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এখনই না। এটা নির্ভর করবে সে সময়ের পরিবেশ এবং পরিস্থিতির উপর। এসব নিয়ে বিরোধে তিনি সিনিয়র নেতাদের দুষছেন। এখন দল না তাঁর আত্মীয়রাই তাঁর মুক্তির পথ তৈরি করছে এবং সেটি তারা করতে চান বিএনপিকে নিষ্ক্রিয় রেখে। আর সেই কাজটি করবেন প্রয়াত কোকোর স্ত্রী।

এদিকে বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থার মেডিকেল রিপোর্ট সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন সিঁথি। বেগম জিয়ার আত্মীয় স্বজনরা আশা করছেন এসব কাগজ পত্র আদালতে জমা দিলে, সহজেই তাঁর জামিন এবং লন্ডন যাওয়ার সুযোগ হবে। একজন চিকিৎসক তাঁর ব্যবস্থাপত্রে ছয় মাস পর বেগম জিয়াকে আবার দেখা করতে বলেছিলেন।

একাধিক সূত্র বলছে, সরকার তাঁর বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে নমনীয়। তবে, বেগম জিয়া নির্বাচন না করলেও বিএনপি যেন নির্বাচনে আসে সে ব্যাপারে সরকার আগ্রহী।

বাংলা ইনসাইডার

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin