hafiz

পদত্যাগ নয় নির্বাচনে লড়তে চাই

রাজনীতি ছাড়ছেন না বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। আগামী নির্বাচনেও লড়তে চান তিনি। আর এ প্রসঙ্গটি এসেছে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের কিংবদন্তি যোদ্ধা তিনি। ফিফা স্বীকৃত বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের সেরা ফুটবলার। জাতীয় রাজনীতির অন্যতম এক চরিত্র।

তেত্রিশ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও যুবসমাজের নির্লিপ্ততা দেখে ক্ষোভ আর হতাশা তৈরি হলেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই থেকে নিরাপদে সরে পড়ার মানুষ নন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখেছেন, অদম্য ছিলেন ফুটবলের মাঠে। আদর্শিক লড়াইয়েও শেষ দেখতে চান রাজনীতির ময়দানে।

পদত্যাগ নয়, লড়তে চান সামনের জাতীয় নির্বাচনে। সামনের কাতারে থাকতে চান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে। দৈনিক মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে রাজনীতিতে সক্রিয় ও আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলেছেন দেশের জ্যেষ্ঠ এ রাজনৈতিক। মেজর (অব.) হাফিজ বলেছেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সে সময় তারুণ্যের যে শক্তি দেখেছি সেটা এখন নেই।

যে লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি সেটাও এখন সুদূরপরাহত বলে মনে হয়। ছাত্র ও যুবসমাজের মনমানসিকতা ও বুর্জোয়া রাজনীতির চালচিত্র দেখে মাঝেমধ্যে হতাশা তৈরি হয়। তবে আমি লড়াই থেকে সরে যাওয়ার মানুষ নই। রাজনীতিতে আছি, থাকবো। পদত্যাগ নয়, শেষবারের মতো আগামী নির্বাচনটা দেখতে চাই, লড়তে চাই। আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। যে নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারবে তেমন নির্বাচনে অবশ্যই অংশগ্রহণ করবো।

সিনিয়র এ রাজনীতিক বলেন, বিশ্ব রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তার ঢেউ লেগেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই রাজনীতি এবং রাষ্ট্রক্ষমতা এখন দুর্বৃত্তদের হাতে পড়েছে। এছাড়া জনগণ ভাবছে যাদের জন্য জীবন দেব তারা কি আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবে? এখানেই মানুষের মনে যত দ্বিধাদ্বন্দ্ব। তবে নির্বাচনের আগেই সে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেটে যাবে।

নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্টতার উদাহরণ দিতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সাবেক এ মন্ত্রী। মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমার সঙ্গে অবিচার করেছে এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। নইলে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ ও রংপুরের মজিবুর রহমানের মতো আমিও দেশের সর্বাধিক ৭ বারের এমপি নির্বাচিত হতাম।

সেবার আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচনে অযোগ্য ছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সরাসরি নির্দেশে আমার অভিযোগ আমলে নেয়নি রিটার্নিং অফিসার ও ডিসি। পরে আমার আইনজীবী ও প্রতিনিধি নির্বাচন কমিশনে গেলে তৎকালীন একজন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাখাওয়াত হোসেন তাদের কথা বলতে দেননি। সেনাপ্রধান চিঠি দিয়ে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে যোগ্য ঘোষণা করতে বলেছিলেন। নির্বাচনে প্রভাব খাটিয়ে আমাকে পরাজিত দেখানো হলেও পরে হাইকোর্টের রায়ে আওয়ামী লীগের সে বিজয়ী ঘোষিত প্রার্থীর এমপিত্ব খারিজ হয়ে যায়।

আরপিও-এর বিধি অনুযায়ী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত হিসেবেও আমাকে বিজয়ী করার কথা। যেমনটি হয়েছিল টাঙ্গাইল সদর আসনে। সেখানেও আমার সঙ্গে অবিচার করে উপনির্বাচন দিয়ে এবং সরকার দলীয় প্রার্থীর মাধ্যমে জোর করে ফলাফল ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিএনপির এ ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বেশ আগে থেকেই নীলনক্‌শার বাস্তবায়ন শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। সেটা শুরু হয়েছে নিজেদের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে। নির্বাচন কমিশন গঠনে যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল ইসি গঠনে তাদের পরামর্শগুলোও আমলে নেয়নি সরকার।

নিজের বাছাইকৃত লোকগুলোর নাম তরিকত ফেডারেশনসহ কিছু দলের মাধ্যমে প্রস্তাব করে তাদের দিয়েই গঠন করেছে কমিশন। আগামী নির্বাচনে যে তারা কারচুপির মাধ্যমে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নেয়ার সব ধরনের চেষ্টা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, তাদের বক্তব্যগুলো খেয়াল করুন। আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যেই পরিষ্কার যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা হারবে। ফলে তারা মরিয়া হয়েই ক্ষমতায় থাকতে চায়।

আওয়ামী লীগ এখন রাজনীতি করছে না। তারা আগামী নির্বাচনে কারচুপির নীলনক্‌শা বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা নিয়েই ব্যস্ত। মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, অতীতের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী থাকলে দুর্বৃত্তরা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকে। সমস্যা হচ্ছে- নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন করা হলে সরকার কারচুপি করে ফলাফল অনুকূলে নিতে পারবে না। তাই এখন আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা সেটা নির্ভর করছে বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায় করতে পারছে কিনা তার ওপর।

বিএনপি নেতাকর্মীদের জোর করে আওয়ামী লীগে যোগদানে বাধ্য করার অভিযোগ করে মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় ইদানীং বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতাকর্মীদের পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ব্যাপক মারধরের পর আওয়ামী লীগে যোগদানের জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। দু’চারজন বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও বেশিরভাগই এলাকা ছেড়ে দিচ্ছেন।

নেতাকর্মীদের না পেলে তাদের মা-বাবাকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার জীবনে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর এমন নির্যাতন আর দেখিনি। হিটলার ও পাকিস্তানি বাহিনীর মতো নির্যাতন করছে এ সরকার। এতদিন ছাত্রলীগ-যুবলীগ যে কাজ করেছে এখন সে নির্যাতনের দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ। বর্তমানে আমার এলাকার ৭ জন নেতাকর্মী ঢাকার নানা হাসপাতালে ও ৩ জন ভারতের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আমার এলাকায় নেতাকর্মীদের বেশিরভাগই কারাভোগ করেছেন। এখনও অনেকে কারাগারে আছেন। এমন চিত্র শুধু আমার নির্বাচনী এলাকার নয়, সারা দেশের।

তিনি আশা করেন আগামী নির্বাচনে- হয় ব্যালট বিপ্লব, নইলে স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান ঘটবে। মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, বাংলাদেশের জনগণ জেগে উঠবে। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারলে নীরব ব্যালট-বিপ্লব ঘটবে। যদি ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারে তাহলে নির্বাচনের দিন বা তার পরের দিন গণঅভ্যুত্থান ঘটবে। কারণ জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ এখন একটি দেউলিয়া রাজনৈতিক দল। ভোটাধিকার হারিয়ে, মানবাধিকার হারিয়ে, মৌলিক অধিকার হারিয়ে মানুষ আজ সরকারের উপর ক্ষুব্ধ। নানা অপকর্ম ও লুটপাটের কারণে মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই আমার মনে হয়, নির্বাচনের আগে জনগণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন দেখা দেবে। চাইলেও সরকার কারচুপির নীলনক্‌শার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন ঘটাতে পারবে না।

৬ বারের সাবেক এমপি হাফিজ বলেন, ভোটারবিহীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিষয়টি একেবারে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মহলে এ সরকারের কোনো প্রকৃত বন্ধু নেই। সরকার যাদের বন্ধু মনে করে তারাও এক্ষেত্রে প্রভুর ভূমিকায়। অন্যদিকে নির্বাচনের গতি-প্রকৃতিই বলে দেবে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীরা দেশে থাকবেন নাকি দেশ ছেড়ে পালাবেন। যদি আগেই গণঅভ্যুত্থানের ভাব-সাব দেখে তাহলে নির্বাচনই হয়তো হবে না, তারা পালাবেন।

তিনি বলেন, সারা দেশের বেশিরভাগ এলাকায় বিএনপির জনসমর্থন ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। এ জনসমর্থন আরো বাড়বে। তাছাড়া নির্বাচনের আগেই জনগণের মধ্যে ভোটাধিকার নিয়ে একটি ঐক্য তৈরি হবে। অন্যদিকে নির্বাচনের আগে মানুষ পরিবর্তনের স্বপ্নে উদ্বেলিত হয়। আগামী নির্বাচনে সেটা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হবে। এছাড়া ২০১৪ সাল থেকেও সরকারের প্রতি জনগণ এখন বেশি ক্ষুব্ধ। তাই জনমত ও জনগণের ঐক্য ডিঙিয়ে সরকার কোনো নীলনক্‌শা বাস্তবায়ন করতে চাইলে শত শত লোকের ওপর দিয়েই তাদের সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর গণঅভ্যুত্থান হলে সেনাবাহিনী বলেন, পুলিশ বলেন; কেউ জনগণের বিরুদ্ধে যায় না, যাবে না।

রাজনীতিতে বিএনপির ব্যর্থতা চিহ্নিত করে দলের এ ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের ব্যর্থতার কারণেই আওয়ামী লীগ এখনও রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। বর্তমান সরকারের এত অপকর্ম, এত দুর্নীতি সত্ত্বেও আমরা সেগুলো জনগণের কাছে ভালোভাবে তুলে ধরতে পারিনি। জনসচেতনতার মাধ্যমে জনমত জোরালো ও জনগণকে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করতে পারিনি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ছাত্র ও যুবকদের প্রভাবিত করতে পারিনি।

রাজনৈতিক পিতার সন্তান হাফিজ ফুটবলার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক। স্বাধীনতার পর ঢাকার মাঠে ডবল হ্যাটট্রিক করা প্রথম খেলোয়াড় হাফিজউদ্দিন আহমেদ দৌড়বিদ হিসেবে ১৯৬৪, ৬৫ ও ৬৬ সালে অর্জন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের দ্রুততম মানবের খেতাব। সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন।

রণাঙ্গনে একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন জীবন বাজি রেখে। ’৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্যু-পাল্টা ক্যুর ধারাবাহিকতায় অবসরে যান তিনি। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের ১০ বছর পর ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হওয়ার পর বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি ২০ বছর এমপি ও কয়েক দফায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি ও এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

উল্লেখ্য, ওয়ান ইলেভেনের সময় বিএনপির সংস্কারপন্থি অংশের মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দলের কয়েকজন সংস্কারপন্থি নেতাকে বহিষ্কার করা হলেও বহাল ছিলেন হাফিজ। ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে দলের পঞ্চম ও ষষ্ঠ কাউন্সিলে পদ-পদবির পরিবর্তন না হলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পান তিনি। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরেই দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin