alig_bnp

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিরোধী অবস্থানে দু’দল

আর বেশি দিন বাকি না থাকলেও আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কী ধরনের সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থান নিয়েছে দেশের দু’ বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।

দু’ বৃহৎ জোটের শরিকদলগুলোও তাদের নেতৃত্বাধীন দু’দলের মতোই বিপরীত অবস্থানে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে যে সংলাপ হয়েছে, তাতে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দলগুলোর স্পষ্ট বিভাজন প্রকাশ পেয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলেছে। বিপরীতে বিএনপি ও তার মিত্ররা বর্তমান অর্থাৎ নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনে আপত্তি জানিয়েছে। জাতীয় পার্টিসহ তিনটি দল সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। সিপিবিসহ ১২টি দল বলেছে, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে।

এমতাবস্থায় আগামী নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন দেশের বিদগ্ধমহল। এ নিয়ে কোনো ফয়সালা না হলে কোনো কোনো রাজনীতিবিদ আবার গণতন্ত্র সংকটের পাশাপাশি কম মাত্রার গৃহযুদ্ধেরও আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। এতে জনমনে দানা বাঁধছে নানা শঙ্কা।

উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচন থেকে সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়ে আসছিল। এ সরকারের প্রধান থাকতেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার স্থায়ীভাবে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল।

কিন্তু এর কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে এই পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে। উচ্চ আদালতে দীর্ঘ শুনানির পর ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস হলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে। এ সংশোধনীর ফলে এখন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে।

তবে বিএনপি ও এর জোটসঙ্গী দলগুলো সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তা সংবিধানে পুনঃস্থাপনের দাবি জানায়। এ দাবি না মানায় তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিনকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ আখ্যায়িত করে পরের বছর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারিতে লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বিএনপি।

প্রায় তিনমাস টানা আন্দোলনে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক মানুষ নিহত ও আহত হয়। এতে সরকারি দল খালেদা জিয়াকে ‘আগুন সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দেয়। আর বিএনপি দাবি করে, আন্দোলনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপাতে এসব কাজ করেছে সরকারি দলের লোকেরাই।

বিএনপি এরপর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বাদ দিয়ে ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ দাবি তোলে। এ নিয়ে একটি সমঝোতার জন্য ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংলাপেরও আহ্বান জানায় দলটি। খালেদা জিয়া ২০১৬ সালের ১৯ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন সম্পর্কিত প্রস্তাবনা উত্থাপনকালে বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশনকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করার জন্য নির্বাচনকালীন একটি সহায়ক সরকারের প্রয়োজন।

এজন্য আমরা আর কিছুদিনের মধ্যে এর একটি প্রস্তাব জাতির সামনে তুলে ধরব। তবে এখনো সেই প্রস্তাব তিনি দেননি। লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর ২৩ অক্টোবর স্থায়ী কমিটির যে বৈঠক হয়, সেখানে এ ব্যাপারে প্রচুর আলোচনা হয়।

১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দীতে এক সমাবেশে খালেদা জিয়া ঘোষণা করেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন দিতে হবে। একই সঙ্গে বেগম জিয়া জানান, আগামী নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে, নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী নিয়োগ দিতে হবে এবং নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার চলবে না।

সমাবেশের পর দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টামণ্ডলী এবং ২০ দলীয় শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যে বৈঠক হয়, সেখানেও শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া।

তবে আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের নেতারা বিএনপির এ দাবিকে একেবারেই নাকচ করে দিয়েছেন। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের যে অবস্থান ছিল তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত নির্বাচনের মতোই আগামী নির্বাচনেও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানে নির্ধারিত পদ্ধতি বহাল রাখতে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে দলটি।

আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা ও সরকারের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা রয়েছে সেই মন্ত্রিসভা ছোট করে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একাধিকবার বলেছেন যে, বর্তমান সংবিধানের অধীনেই একাদশ নির্বাচন হবে। আর সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন শেখ হাসিনা।

প্রসঙ্গত, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে শুধু রুটিন (নিয়মিত) কাজ করবে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করে নির্বাচন পরিচালনার মূল কাজটি করবে নির্বাচন কমিশন। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান ছিল। এখন পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এই ৯০ দিন সংসদ থাকলেও অধিবেশন বসবে না। এই তিন মাস প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের সব অনুষঙ্গ সংবিধানের ১১৮ থেকে ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলবে।

সে অনুযায়ী নির্বাচন করার পুরো কর্তৃত্ব নির্বাচন কমিশনকে দেয়া হয়েছে। আর নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ফলাফলের গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের কোনো নির্দেশ দেয়ার সুযোগ রহিত করা হয়েছে। সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদে নতুন একটি দফা যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, তফসিল ঘোষণার পর কোনো আদালত নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারবেন না।

অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের দাবি, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত। বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় রাজনীতিতে চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছে। নির্বাচন নিয়ে জনমনে অনিশ্চয়তা আছে। এজন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপায় বের করতে হবে। এ জন্যই সরকারকে বার বার সংলাপে বসার তাগিদ দেয়া হচ্ছে।

এ ব্যাপারে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এক ধাপ এগিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দু’টি পথ আছে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার। একটা হলো সš§ানজনকভাবে বিদায় নেয়া। আরেকটি হলো একেবারে অপমানিত-লাঞ্ছিত এবং একেবারে অসš§ানের সঙ্গে পদত্যাগ করা বা সরকার থেকে চলে যাওয়া।

তিনি বলেন, উনাকে (প্রধানমন্ত্রী) এখন পছন্দ করতে হবে যে, কোনটা উনি চান। যদি উনি সš§ানের সঙ্গে যেতে চান, তাহলে সমঝোতায় আসতে হবে। একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে আওয়ামী লীগ যদি হেরেও যায় তবুও প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) সš§ানের সঙ্গে বিদায় নেবেন। সংকট নিরসনের সমঝোতা না হলে আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ার ইঙ্গিতও দেন মওদুদ।

বিএনপির অপর সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে দাবি তুলেছে, তা নিয়ে ‘সমঝোতা’ না হলে ‘রাস্তায়’ ফয়সালা হবে। আমরা জোর দিয়ে বলি, বিএনপি একাদশ জাতীয় নির্বাচন করবে। তবে তা শেখ হাসিনার অধীনে নয়। আমাদের নেত্রী উপযুক্ত সময়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা দেবেন। এরপরে আমরা সরকারের আচরণ দেখব, তারা (সরকার) সেই রূপরেখায় আসে কি না- সেটা দেখে প্রয়োজনে আমরা জনগণের কাছে যাব।

তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের অধিকার জনগণই প্রতিষ্ঠা করবে, রাস্তায় নেমে প্রতিষ্ঠা করবে। আমরা বিএনপি জনগণের সঙ্গে থাকব। জনগণ তাদের ভোটের অধিকারের দাবি আদায় করেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে।

বিএনপি নির্বাচন কমিশনের যে সংলাপ করেছে, তাতে প্রস্তাব দিয়েছে যে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সংলাপের কার্যকর উদ্যোগ নির্বাচন কমিশনকে নিতে। তবে এ প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনী ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনে সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নির্বাচন কমিশন নেবে না।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। তারা জানান, এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যকার বিপরীতমুখী অবস্থানের সমাধান কী হবে এবং সমঝোতার দায়িত্বই বা কে নেবে- এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট বাম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এ নিয়ে সরকারের দিক থেকে একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ দরকার। এর মাধ্যমে দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা। তবে আমরা এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ লক্ষ্য করছি না। তাই আগামী নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা জনমনে দানা বাঁধছে।

জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য একটি ভয়ভীতিহীন গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে সরকার যদি উদ্যোগ গ্রহণ না করে, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংকটে পড়ার পাশাপাশি এতে একটি ‘লো ইনটেনসিটি’ অর্থাৎ কমমাত্রার গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে। তাতে কেবল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সবার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।

এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের দেশের রাজনীতিটাই বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। বড় দু’টি দল সব সময় উল্টো অবস্থানে থাকে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে দু’দলকেই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলাপ-আলোচনা ছাড়া এ সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়।

মানবকণ্ঠ

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin