bnp_jamat

দর কষাকষি করবে না জামায়াত

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপির কাছে জামায়াতে ইসলামীর দাবি ছিল ৬০টির বেশি আসন। তার বিপরীতে ৩৮টি আসনে নির্বাচনের সুযোগ পেয়েছিল দলটি। আগামী নির্বাচনে অত আসন ছাড়তে হবে না বিএনপিকে। জামায়াত সূত্র বলছে, জিততে পারবে এমন ১৫-২০টি আসন দিলেই সন্তুষ্ট থাকবে তারা। এ নিয়ে এবার দর কষাকষিতে যেতে চায় না দলটি।

জামায়াতের এক নেতা কারণ হিসেবে জানান, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত এবং ওই অপরাধে কয়েক নেতার ফাঁসি হওয়ায় রাজনীতির মাঠ তাদের জন্য মসৃণ নয়। যেসব নেতা সংসদ সদস্য ছিলেন এবং নির্বাচন করতেন, তাদের কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে। আরও কয়েকজনের ফাঁসি হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে শীর্ষ নেতৃত্বে ব্যাপক রদবদলে দলের অবস্থাও ভালো বলা যাবে না। তাই জিততে পারে, এমন কিছু আসনে প্রার্থিতা চাইবেন তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্যসহ একাধিক সিনিয়র নেতা বলেন, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এখন ওই পর্যায়ে গড়ায়নি। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী জামায়াত বেশি আসন দাবি করতে পারে না। তা ছাড়া বিগত জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের চাপ প্রয়োগের কারণে এমন কিছু আসন ছাড়তে হয়েছে, যার জন্য কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া যায়নি। সব দিক বিবেচনা করে বিএনপিও চাইবে যতটা কম আসন তাদের দেওয়া যায়।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। সময় হলে সব দিক বিবেচনায় নিয়ে কত আসন ছাড়া যায় তা ঠিক করা হবে। আর এ বিষয়ে জোটনেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

জানা গেছে, মাঠের রাজনীতিতে অতটা সক্রিয় না থাকলেও ঘরোয়া রাজনীতিতে আছে জামায়াত। বিএনপি মহাসচিবসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে তাদের মতবিনিময়ও হয়। কয়েক মাস আগে গুলশানের একটি বাড়িতে দুই দলের নেতারা বসেছিলেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আব্দুর রব বলেন, জামায়াতে প্রার্থিতা নিয়ে টানাপড়েন নেই। প্রতীক ও নিবন্ধন ফিরে না পেলে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হবে।

কত আসনে জামায়াতের প্রার্থী দেওয়া হবেÑ এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। আমরা কিছু আসনের তালিকা দিয়েছি। আলোচনার ভিত্তিতে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হবে।

বিএনপির সঙ্গে নানা টানাপড়েন পেছনে ফেলে আগামী নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মেই নির্বাচনের বিষয়টি অনেকটা চূড়ান্ত। যদিও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটি ২০১৩ সালে আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারিয়েছে, পাশাপাশি বাতিল হয়েছে প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও। তবে দল হিসেবে এখনো জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এর পরও ৫১টি আসনে প্রাথমিকভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।

সূত্র জানায়, জামায়াতের সংসদীয় বোর্ড ইতোমধ্যেই প্রার্থীতালিকা তৈরি করেছে। দলের গঠনতন্ত্রের ২৫ ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সংসদীয় বোর্ডের দায়িত্বে রয়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতামত-প্রস্তাব ও তথ্য যাচাই করে বোর্ডই প্রার্থিতার বিষয়টি চূড়ান্ত করে।

জামায়াতের অভ্যন্তরীণ জরিপ অনুযায়ী জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা ৫১ আসন টার্গেট করে প্রতি আসনে ২০ জনের একটি করে টিম সংশ্লিষ্ট আসনে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে পাঠিয়েছিলেন। তারা পালাক্রমে এলাকায় অবস্থান করে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে নির্বাচনের বাস্তব হালচাল তুলে ধরেন। এসব প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই চূড়ান্তভাবে প্রার্থী মনোনীত করবে জামায়াত।

জানা গেছে, দলের কয়েকজন নেতা ধানের শীষে নির্বাচন করতে চান। ওই নেতাদের আসনে জামায়াতের অবস্থান ভালো নয় বলে তারা এটি চাচ্ছেন বলে ভেতর থেকে এর বিরোধিতা এসেছে।

জামায়াতের বেশ কয়েকজন নীতিনির্ধারক ও শীর্ষপর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জোটের প্রধান দল বিএনপির সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছে জামায়াত। খালেদা জিয়া লন্ডনে থাকাকালে জামায়াতের কয়েকজন মধ্যম সারির নেতা তার সঙ্গে নির্বাচনের রূপরেখা নিয়ে কথা বলেছেনÑ এমনটিও শোনা যায়।

জামায়াতের বিএনপি জোটের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি খোলাসা করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। সম্প্রতি সৈয়দপুর বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকবে। তিনি বলেন, আমাদের জোট অটুট। এখনো জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাই তারা আমাদের সঙ্গে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।

জানা যায়, বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোটের মাপকাঠিতে জনপ্রিয় এলাকাগুলো বাছাই করা হয়েছে ২০১৯ সালের নির্বাচনের জন্য। দলটির অতীত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জামায়াতের নির্দিষ্ট কিছু আসন ঘিরেই ভোটব্যাংক। বিভিন্ন সময় এসব আসন থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্যরা। এর বাইরে যেসব আসনে গত দুটি উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন, সেসব আসনও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

জামায়াত সূত্র জানায়, জোটগত নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইতিহাস জামায়াতের পুরনো। ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রব্বানী পার্টি এবং জামায়াত যৌথভাবে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করে। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ জোট থেকে জামায়াত ছয়টি আসন পায়। স্বাধীন বাংলাদেশে এটা জামায়াতের প্রথম নির্বাচনে অংশগ্রহণ হলেও দলগত পরিচয়ে প্রথম অংশগ্রহণ করে ১৯৮৬ সালের ৭ মের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে। এ নির্বাচনে ৭৬টি আসনে দলটি মনোনয়ন দিলেও ১০টি আসনে বিজয়ী হয়।

১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দল হিসেবে মূলধারার প্রায় সব দলই বর্জন করে। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ২২২ আসনে প্রার্থী দেয়। তবে এতে জয়লাভ করে মাত্র ১৯টি আসনে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত মাত্র তিনটি আসনে জয়লাভ করে।

এর পর ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর বিএনপি, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী জোটগত আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করে, যা পরবর্তি সময়ে নির্বাচনী জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে বিএনপি ২৯টি আসনে জোটগতভাবে নির্বাচনের সুযোগ দেয়।

এতে ১৭টি আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয় দলটি। সংসদের মহিলা আসনগুলো থেকে জামায়াতে ইসলামী চারটি আসন লাভ করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট থেকে জামায়াত ৩১টি আসনে নির্বাচন করে। এর বাইরে দুটি আসন বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থীরা ছাড় না দেওয়ায় উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে এ নির্বাচনে মাত্র দুটি আসনে জয়লাভ করে দলটি।

বিএনপি সূত্র জানায়, জামায়াতের সঙ্গে জোটগতভাবে দুটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি। তবে এতে জামায়াতের সফলতা আশাব্যঞ্জক নয়। প্রথমবার ২৯টি আসনে নির্বাচন করে মাত্র ১৭টি আসনে জয়লাভ করে। এর পর ৩৩টি আসনে নির্বাচন করে জয়লাভ করে মাত্র ২টি আসনে। তাই এবার বিএনপির পক্ষ থেকে দলটিকে ১৫ থেকে বিশটি আসনে জোটগত মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতারাও এক্ষেত্রে অনেকটা নমনীয়। সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা ভাবছেন, জয়লাভ করার সম্ভাবনাময় আসনগুলো থেকে নির্বাচন করাটাই যুক্তিযুক্ত।

আমাদের সময়

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin