জিয়া পরিবার বনাম বিএনপি

বেগম জিয়ার মুক্তি, আন্দোলন, নির্বাচন – এই তিন প্রশ্নে জিয়া পরিবারের সঙ্গে বিএনপি নেতৃবৃন্দের বিরোধ এখন প্রকাশ্য। দলের শীর্ষ নেতাদের বিশ্বাস করতে পারছেন না বেগম জিয়ার পরিবারের সদস্যরা। অন্যদিকে, দলের স্বার্থ না দেখে ব্যক্তি স্বার্থ দেখার অভিযোগ উঠেছে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে। এইসব দ্বন্দ্ব বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত ভাঙনের দিকেই নিয়ে যাবে বলে মনে করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি দলের দায়িত্ব তাঁর লন্ডনে পলাতক ছেলের উপর ন্যস্ত করে যান। কিন্তু বিএনপি নেতারা তাঁকে প্রকাশ্য নেতৃত্বে আনতে অস্বস্তি প্রকাশ করছে। বরং বিএনপিতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার্যকর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এটা বেগম জিয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।

বিশেষ করে, দলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তারেক জিয়াকে অন্ধকারে রেখেই। তাছাড়া চট্টগ্রাম এবং খুলনার জনসভায় তারেক জিয়া বক্তব্য রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে আইনগত সমস্যার কথা বলে বক্তৃতা দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। ক্ষুব্ধ তারেক জিয়া এরপর জানিয়ে দেন ‘ আপনারাই দল চালান ।‘

বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইমেজ সংকট এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণেই তাঁরা তারেক জিয়াকে সামনে আনতে পারছেন না। একজন বিএনপি নেতা বলেছেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন গ্রেপ্তার হবার পর আমরা কূটনীতিকদের সঙ্গে দুটি বৈঠক করেছি। দুটিতেই তারেক জিয়াকে নিয়ে নেতিবাচক কথা হয়েছে। তাছাড়া হাইকোর্টের একটি আদেশে তারেক জিয়ার বক্তৃতা, বিবৃতি প্রচারে আইনগত নিষেধাজ্ঞা আছে এমন বক্তৃতা বিবৃতি দিলে বিএনপির উপরই খড়গ নেমে আসতে পারে।

বেগম জিয়া মুক্তি নিয়েও বিএনপি নেতৃবৃন্দ এবং জিয়া পরিবারের মধ্যে মতবিরোধ তুঙ্গে। বিএনপির নেতৃবৃন্দ চায় বেগম জিয়ার মুক্তি এবং বিদেশ যাত্রার আগে কিছু বিষয় সরকারের সঙ্গে রফা করতে। যেমন: বিএনপির আটক নেতা কর্মীদের মুক্তি, নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ইত্যাদি। কিন্তু জিয়া পরিবার মনে করছে, বেগম জিয়াকে জিম্মি করে বিএনপির দাবি আদায়ের কৌশল নিয়েছে।

এটা ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেছেন জিয়া পরিবারের সদস্যরা। জিয়া পরিবার চাইছে, আগে বেগম জিয়া মুক্তি নিয়ে বিদেশে যাক, তারপর দাবি দাওয়া দেখা যাবে। কিন্তু বিএনপি নেতারা বলছেন, একবার বেগম জিয়া বিদেশে চলে গেলে, সরকার তাদের কোনো কথাই শুনবে না। বিএনপি নেতাদের এরকম মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া পরিবারের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করছেন, বিএনপি নেতাদের অনীহা এবং আন্তরিকতার অভাবেই বেগম জিয়ার জামিন হয়নি।

আন্দোলনের কৌশল নিয়েও জিয়া পরিবারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের মতবিরোধ রয়েছে। তারেক জিয়া এবং জিয়া পরিবারের সদস্যরা চাইছিলেন জেলগেট কেন্দ্রীক কর্মসূচি। যেমন কারাগারের সামনে অবস্থান, কারাগারের সামনে অনশন। কিন্তু সরকারের অনুমতি পাওয়া যায়নি, এই অজুহাতে বিএনপি নেতারা কারাগারের সামনে কোন কর্মসূচী দেয়নি। জিয়া পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ঢাকাতেও তো জনসভার অনুমতি সরকার দেয়নি। কিন্তু কর্মসূচি তো ঘোষণা করা হয়েছিল। বিএনপি গা বাঁচাতেই এবং সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করতেই এভাবে সমঝোতার কর্মসূচি নিচ্ছে।

বেগম জিয়া এবং তারেক জিয়া পর্যন্ত বিএনপি নেতারা মেনে নিয়েছিল। কারণ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাঁরা দু’জন বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তারের পর তাঁর ভাই, বোন এবং সবশেষে প্রয়াত কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান দলের খবরদারি করছেন। একাধিক বিএনপি নেতৃবৃন্দ বলছেন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এরা বিএনপির কেউ নন। তাহলে কেন এরা দলের কাজে নাক গলাবেন?

এসব পরিস্থিতির কারণে না হচ্ছে আন্দোলন, না হচ্ছে বেগম জিয়ার মুক্তি। এ অবস্থায় দলে বাড়ছে হতাশা এবং অবিশ্বাস। একটি দল ভাঙার জন্য এই দুটি উপাদানই যথেষ্ট।

তারেক জিয়ারই জয় হলো

অবশেষে তারেক জিয়ারই জয় হলো। বিএনপির অধিকাংশ নেতাই আসন্ন সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিপক্ষে থাকলেও, তারেক জিয়া সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে মত দেন।

গতরাতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বসেছিলেন গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে। বৈঠকে চলমান আন্দোলন এবং আসন্ন সিটি নির্বাচন অংশ নেওয়া না নেওয়া বিষয়ে আলোচনা হয়। অধিকাংশ নেতাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সিটি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষে মত দেন। বৈঠকের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডন থেকে ফোন করেন তারেক জিয়া। তিনি প্রায় ১০ মিনিট বক্তব্য রাখেন।

আসন্ন সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন তারেক জিয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলনকে জোরদার করারও আহ্বান জানান তারেক। এই নির্বাচন সরকারকে আরও চাপে ফেলবে বলেও তারেক মন্তব্য করেন। এরপরই পাল্টে যায় বৈঠকের আবহাওয়া। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সিদ্ধান্ত বদলে সবাই নির্বাচনে যাবার পক্ষে অবস্থান নেন।

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, নির্বাচন হলেই তারেক জিয়ার লাভ। যারা মনোনয়ন পাবেন, তাদের তারেক জিয়াকে টাকা দিয়েই মনোনয়ন নিতে হবে। এমনকি ওয়ার্ড কমিশনারদেরও মনোনয়ন নিতে তারেক জিয়াকে খুশি করতে হবে। মূলত: মনোনয়ন বাণিজ্য করতেই নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তারেক, এমন অভিমত বিএনপির।

বৈঠকের শুরুতেই বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাস এবং নজরুল ইসলাম খান নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নেন। তাঁরা বলেন ‘বেগম খালেদা জিয়ার ইস্যু থেকে বিএনপিকে সরাতেই নির্বাচনী ফাঁদ পাতা হয়েছে।’ দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল অবশ্য এই বৈঠকে তাঁর মতামত দেননি।

বাংলা ইনসাইডার

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin