ershad

জাতীয় পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা: এরশাদ

‘বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ ও জনপ্রিয় নেতা জাতীয় পার্টিতে যোগদান করছেন’ বলে দাবি করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। তবে তাদের নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

মঙ্গলবার দুপুরে রংপুরে এসে সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে জাপা চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন। তিনি ৩ দিনের সফরে রংপুর রয়েছেন। এর আগে সকালে ঢাকা থেকে বিমানযোগে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে অবতরণের পর সরাসরি মোটর শোভাযাত্রা সহকারে রংপুর সার্কিট হাউজে আসেন। এ সময় এরশাদের সঙ্গে ছিলেন ছোট ভাই জাপার (এ) কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিয়ার রহমান রাঙ্গা। পরে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নর্বনির্বাচিত মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ও মহানগর জাতীয় পার্টির (এ) সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসিরসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী তাকে স্বাগত জানান।

এইচএম এরশাদ বলেন, ‘কেউ যদি ইচ্ছে করে আমার দলে যোগ দিতে চায় কেন তাদের নেবোনা। তারা যদি ভাল নেতা হয়, যোগ্য প্রার্থী হয়, তাদের অবশ্যই দলে নেব এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের মনোনয়ন দেবো।’

জাপা চেয়ারম্যান বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করুক আর না করুক তাতে কিছুই যায় আসেনা। তাদের জন্য নির্বাচন বন্ধ হবেনা, নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (এ) অংশ নেবে। এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল আছে আর আওয়ামী লীগ তো আছেই। ফলে নির্বাচন না করার ব্যাপারে বিএনপির হুমকি-ধামকি দেখিয়ে কোনো লাভ হবেনা।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়া প্রসঙ্গে এরশাদ বলেন, রাজনীতি করলে জেলে যেতে হবে। আমিও জেলে গিয়েছি। আর রায় দিয়েছেন বিচারক। দুর্নীতির মামলায় তার বিচার হয়েছে, তার জেল হয়েছে। এনিয়ে এতো বাড়াবাড়ি এতো হৈ-চৈ করে কি লাভ।

রাজনীতিতে এরশাদ যেভাবে টিকে গেলেন
৩৫ বছর আগে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলনের সূচনা করেছিল। সেদিন ঢাকায় শিক্ষাভবন অভিমুখে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়।

সেই আন্দোলন কালক্রমে গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল এবং জেনারেল এরশাদের শাসনের পতন হয়েছিল নব্বইয়ের শেষে। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে পতন হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন জেনারেল এরশাদ।

কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব হয়েছে, এমন প্রশ্ন তোলেন অনেকেই।
বিশ্লেষকদের অনেকে এজন্য আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, প্রধান দুই দলের ক্ষমতার রাজনীতিকে দায়ী করেন।

ঢাকায় শিক্ষাভবনের উল্টো পাশে কার্জন হলের সামনের রাস্তায় জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সেই ৮৩সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি প্রথম ছাত্র মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।

সেখানে নিহত ছাত্রদের স্মরণে রাস্তার কোণায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। প্রতিবছরের মতো এবারও দিনটি ফিরে এলে সেই ছাত্র মিছিলের নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের অনেকে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে নিহতদের শ্রদ্ধা জানিয়ে সেদিনের কথা স্মরণ করেন।

স্মৃতিস্তম্ভ
সেই মিছিলের একজন সংগঠক, তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক পুলিশের গুলির মুখে মিছিলের সামনের কাতারে থেকেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।

তিনি বলছেন, গত সাড়ে তিন দশকে দেশের রাজনীতিতে জেনারেল এরশাদের একটা অবস্থান দেখে তাদের এখন দুঃখ হয়। সেই যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, পরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল শ্রমিক, আইনজীবীসহ পেশাজীবীদের মধ্যে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫দল এবং বিএনপির নেতৃত্বে সাতদল এবং এর বাইরে অন্যান্য দল যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছিল।

আন্দোলন মাঝেমধ্যে থমকে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত সব দলের ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল।

তখন তাকে জেলে নেয়া হলেও পরে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার মতো তার একটা অবস্থান তৈরি হয়।

অধ্যাপক রওনক জাহান মনে করেন, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, প্রধান দুই দলের কাছে ভোটের রাজনীতি প্রাধান্য পায়। সেই সুযোগে জেনারেল এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে বৈধতা পেয়েছে

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রওনক জাহান বলেছেন, জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র ফিরে এলেও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, প্রধান দুই দলের কাছে ভোটের রাজনীতি প্রাধান্য পায়। সেই সুযোগে জেনারেল এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে বৈধতা পায় বলে তিনি মনে করেন।

‘নির্বাচনের গণতন্ত্র যখন ফেরত এলো, ১৯৯১ সালের পর থেকে আমরা যে ক’টা নির্বাচন দেখেছি, ওদের পপুলার ভোটের শেয়ার যে অনেক আছে, তা নয়। কিন্তু কয়েকটা আঞ্চলিক জায়গায় এরশাদ নিজে এবং তার দলের কিছু লোক নির্বাচিত হয়ে আসতে পারছেন।’

‘যেহেতু প্রধান দু’টি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের শেয়ার খুব কাছাকাছি, এবং আমাদের যে ইলেকটোরাল সিস্টেম, তাতে কোন নির্বাচনী এলাকায় কেউ অল্প ভোটের ব্যবধানে জিতে যেতে পারেন। ফলে এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং অন্যদিকে জামায়াত, যাদের কাছে ছয় বা সাত শতাংশ ভোট আছে, প্রধান দুই দল তাদের কাছে টানে। এভাবেই এরশাদ রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়ে যাচ্ছেন।’

নববইয়ের শেষে জেনারেল এরশাদের পতনের সাথে সাথেই ঢাকার রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছিল। মানুষের উচ্ছ্বাস আনন্দে সে সময় নগরীর রাস্তাগুলো ভিন্ন চেহারা নিয়েছিলো।
সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে এখনও অনেকে বিস্মিত হন রাজনীতিতে জেনারেল এরশাদের অবস্থান দেখে।

তবে রাজনীতি বিষয়ে গ্রন্থের লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বিশ্লেষণ করছেন ভিন্নভাবে।

তিনি বলছেন, প্রধান দুই দলের বিভেদের রাজনীতির সুযোগ নিয়ে এরশাদ নয় বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছেন। ক্ষমতা ছাড়ার পরও একই ধরণের সুযোগ তাঁর কাছে এসেছে বলে তিনি মনে করেন।
‘আমাদের দেশে রাজনীতির যে বিভাজন, দুই পরাশক্তি বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ, এদের একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে খেলিয়ে অনেক সময় এরশাদ এর সুবিধা নিতে পেরেছেন।’

মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলছিলেন, ‘আমরা তো সুদূর অতীতটা ভুলে যাই, নিকট অতীত মনে রাখি। এরশাদের যত খারাপ কাজ আছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা, সংবিধানকে বিকৃত করা, এগুলো অনেক কিছু করেছে। কিন্তু ঐ যে গণতন্ত্রের কথা বলেন যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি তারা তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। তাকে শাস্তি দিতে চায়নি। এবং শাস্তি যদি দিতেও চেয়ে থাকে,সেটাও হচ্ছে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে ব্যবহার করার জন্যে। এজন্যেই কিন্তু এরশাদ টিকে গেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজেয় বাংলার পাশে বটতলায় জড়ো হয়ে সেখান থেকেই ছাত্ররা জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে সেই প্রথম মিছিল বের করেছিলেন। এখন নতুন প্রজন্মও রাজনীতিতে এরশাদের অবস্থানকে মেনে নিতে পারেন না। তারাও মনে করেন, এমন পরিস্থিতির জন্য প্রধান দুই দলেরই দায় রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে এমন ধারণাই পাওয়া গেল।

তাদের একজন সানজিদা আকতার বলছিলেন, ‘এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা এবং দেউলিয়াপনার কারণে এরশাদের মতো স্বৈরশাসক এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে রয়েছে।’

সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ জেনারেল এরশাদকে এক ধরণের বৈধতা দিয়েছিল বলে দলটির বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে।
পরে ১৯৯৬ সালে সরকারের গঠনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তারা মহাজোট করেছিল। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও অনেক নাটকীয়তার পর শেষপর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে সাথে রাখতে সক্ষম হয়েছিল আওয়ামী লীগ।

ন দুই দলের কাছে দর কষাকষির অবস্থানে এসেছেন, সেটাকে বিশ্লেষকদের অনেকে বাস্তবতা বলে মনে করেন।

আবার অনেকে মনে করেন, আগের তুলনায় আঞ্চলিক ভিত্তিতেও জাতীয় পার্টির জায়গাগুলোতেও তাদের আসন কমে আসছে, সেটা কিছুটা ইতিবাচক ইঙ্গিত হতে পারে।

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin