ziya_khaleda_old_photo

জাগদল থেকে বিএনপি: রাজনীতিতে জিয়ার উত্থান

(বাংলাদেশে সামরিক শাসনের অধীনে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি গড়ে তুলেছিলেন। আজ দলটির ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। লেখক-গবেষক মহিউদ্দীন আহমদের লেখা ‘বিএনপি সময়-অসময়’ বইতে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে এই দল গঠনের নেপথ্য কাহিনী। বইটির নির্বাচিত অংশ সংকলন করেছেন আকবর হোসেন:)

১৯৭৫ সালের ১১ নভেম্বর বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, “আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সৈনিক।…. রাজনীতির সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই এবং আমাদের সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক।”

এরপর ১৯৭৬ সালের মে মাসে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, “আমি একজন শ্রমিক।”

একজন ‘শ্রমিক’ ও ‘সৈনিক’ কিভাবে একের পর এক সিঁড়ি পেরিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে চলে যেতে পারেন, তার একটা চিত্রনাট্য আগেই লিখে রেখেছিলেন পাকিস্তানের সেনাপতি আইয়ুব খান। জেনারেল জিয়া এ চিত্রনাট্য ধরেই এগুতে থাকেন এবং অবশেষে গন্তব্যে পৌছে যান।

জিয়াউর রহমান স্বভাবে ছিলেন ধীর-স্থির। তিনি এক-পা, দুই-পা করে এগুচ্ছিলেন। তিনি মনে করলেন, তাঁর একটা ঘোষণা-পত্র বা কর্মসূচী থাকা দরকার। উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর জোর দিয়ে ১৯৭৭ সালের ২২শে মে ‘আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে’ জেনারেল জিয়া ১৯দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন।

তিনি তখনো একজন সামরিক শাসক। সেনাবাহিনীতে দৃশ্যত তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ ছিলনা। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক বিরোধীরা বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন এবং দিশেহারা। তারপরেও জিয়াউর রহমানকে প্রমাণ করতে হবে, তাঁর পেছনে জনসমর্থন আছে; শুধু বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় বসেননি।

আরও পড়ুনঃ ‘ভালো নেই খালেদা জিয়া তবে মনোবল শক্ত’

তাঁর প্রতি জনগণের আস্থা আছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য হ্যাঁ-না ভোট নেয়া হলো। নির্বাচন কমিশন জানাল, দেশের ৮৮.৫০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৯৮.৯ শতাংশ হ্যাঁ ভোট দিয়েছে।

ভোটার উপস্থিতির এ হার মোটেও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। গণভাটের মাধ্যমে রাজনৈতিক বৈধতার একটি ছাড়পত্র তৈরি করলেন জিয়াউর রহমান।

জেনারেল জিয়া তাঁর উপদেষ্টামন্ডলীতে অসামরিক কিছু তারকা যোগ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মুহাম্মদ শামসুল হক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ অন্যতম।

জিয়াউর রহমান ইতোমধ্যে রাজনীতিবিদদের যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে তিনি যাঁদের সাথে কথাবার্তা বলা শুরু করেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাসানী-ন্যাপের সভাপতি মশিউর রহমান যাদু মিয়া।

১৯৭৫ সালে যারা ঢাকঢোলা পিটিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন, মধ্য আগস্টে গণেশ উল্টে যাওয়ায় তাদের অনেকেই বাকশালের গালমন্দ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, নতুন শাসকদের কৃপা পাওয়া। জিয়াউর রহমান এসব রাজনীতিবিদকে দেখতেন কিছু করুণা আর কিছু ঘৃণা নিয়ে।

ziya_khaleda_old_photo

জেনারেল জিয়ার কাছে যারা ভিড়েছিলেন বা ভিড়তে চেয়েছিলেন, তাদের কারও কারও অভিজ্ঞতা ছিল বেশ তেতো। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ছাত্র লীগের সাবেক নেতা এবং প্রথম জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিন বর্তমানে বিএনপি নেতা।

খন্দকার মোশতাক ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে ডেমোক্রেটিক লীগ নামে যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন, শাহ মোয়াজ্জেম সে দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান যখন রাজনীতিবিদদের সাথে যোগাযোগ করছিলেন, এক পর্যায়ে শাহ মোয়াজ্জেমের সাথেও তাঁর কথা হয়। খন্দকার মোশতাক তখন জেলে। ঠিক হয় ডেমোক্রেটিক লীগের পক্ষ থেকে শাহ মোয়াজ্জেম, মোহাম্মদ উল্লাহ, অলি আহাদ এবং কে এম ওবায়দুর রহমান বঙ্গভবনে জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করবেন এবং কথাবার্তা বলবেন। কিন্তু নিমিষেই শাহ মোয়াজ্জেমের স্বপ্নের বেলুন ফুটো হয়ে যায়।

শাহ মোয়াজ্জেমকে একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ তার বইতে লিখেছেন, ” বঙ্গভবনে যাচ্ছি বলে আনন্দিত হয়েই গাড়িতে গিয়ে বসলাম। বসে বসে ভাবছিলাম আলাদা কী আলোচনা করতে পারেন প্রেসিডেন্ট সাহেব! ওয়ারী থেকে বঙ্গভবন পাঁচ মিনিটের রাস্তা। কিন্তু দশ মিনিটের ওপর হয়ে গেল গাড়ি চলছেই।

আরও পড়ুনঃ বিএনপি এখন কী করবে !

বিষয় কী? বাইরে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, বঙ্গভবনের রাস্তা এটা নয় – অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, আমার তো বঙ্গভবনে যাবার কথা, আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? তারা এবার আর মিথ্যার আশ্রয় নিল না। বলল, স্যার, যাবেন আপনি ঠিকই, তবে বঙ্গভবনে নয়। আপাতত ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। ঘৃণায় তাঁদের দিকে ফিরেও তাকালাম না। এ ঘৃণা সে লোকটির জন্য যে এতো বড় উচ্চাসনে অবস্থান করেও এমনই নিচু স্তরের প্রবঞ্চনা এবং অহেতুক নিপীড়নের পন্থা বেছে নিতে পারে.. ”

জিয়া রাজনৈতিক দল তৈরির আগেই একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের চিন্তা করেন, যাতে করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটা বিস্তৃত প্লাটফর্ম বানানো যায়। একটা নির্দিষ্ট দর্শন ও কর্মসূচীর চেয়ে তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পাল্টা একটা বড়সড় মঞ্চ তৈরী করা।

জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দল তৈরির প্রক্রিয়াটিতে বৈচিত্র্য ছিল। তিনি সব কটি ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে চাননি। দল তৈরির কাজে অনেক ব্যক্তি ও মাধ্যমকে ব্যবহার করেছন। তখনকার সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর অফিসে রাতের বেলায় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা আসতেন এবং কথাবার্তা বলতেন। জিয়া কখনে-সখনো সেখানে উপস্থিত থাকতেন। জিয়ার একান্ত সচিব কর্ণেল অলি আহমদের সাথে মাঠ পর্যায়ের অনেক লোকের যোগাযোগ ছিল। অলি আহমেদ ২০০৬ সালে বিএনপি ছেড়ে এলডিপি গঠন করেন।

জিয়াউর রহমান একদিকে ‘সমমনা’ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক জোট তৈরির কাজ করছেন, অন্যদিকে তিনি নিজস্ব একটা রাজনৈতিক দল তৈরির বিষয়টিও খুব গুরুত্বের সাথে দেখলেন। তাঁর মনে হলো জোটের মধ্যে শতভাগ অনুগত একটা দল না থাকলে জোটকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সে লক্ষে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল’ বা ‘জাগদল’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল তৈরির ঘোষণা দেন। তিনি নিজে থাকলেন নেপথ্যে।

আরও পড়ুনঃ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হলে খালেদা নয় হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী হবেন : ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন

জাগদল রাজনীতিতে তেমন ঢেউ তুলতে পারেনি। রাজনৈতিক মাঠের চেনা মুখগুলো জাগদলে খুব কমই যোগ দিয়েছিল।

১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল জিয়াইর রহমান নিজেই নিজেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নোতি দিলেন। ১৯৭৮ সালের ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ ঘোষণা করা হলো। জিয়া যদিও সেনাবাহিনীর প্রধান, তিনি পুরাদস্তুর রাজনীতিবিদ বনে গেলেন।

একসময় তিনি বলেছিলেন, ” আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট”। অর্থাৎ তিনি রাজনীতি কঠিন করে দেবেন।

নানা বিধি নিষেধের বেড়াজালে অনেকের জন্যই রাজনীতি কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু জিয়া রাজনীতিতে তাঁ উত্তরণ ঘটান সহজেই। রাজনীতিবিদ হতে হলে মাঠে-ঘাটে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে হয়। হাতের তর্জনী তুলে গর্জন করতে হয়। জিয়া এ বিষয়ে একেবারেই নবিশ। অথচ রাজনীতিতে পারঙ্গম হতে হলে জনগণের সাথে মিশে যেতে হবে।

মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ভাই মোখলেসুর রহমানের (সিধু ভাই)একটি সাক্ষাতকারকে উদ্ধৃত করে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, “জিয়া বাংলা লিখতে-পড়তে জানতেন না। প্রথম দিকে তিনি বাংলায় যে বক্তৃতা দিতেন, সেগুলো উর্দুতে লিখতেন। তারপর সেটি দেখে বক্তৃতা দিতেন। তিনি ভালো করে বক্তৃতা দিতে পারতেন না। দিতে গেলে খালি হাত-পা ছুঁড়তেন।”

zia_old_photo
জিয়াউর রহমান: আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট

মোখলেসুর রহমানের সাক্ষাতকার গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর বইতে এভাবে তুলে ধরেছেন, “এসব দেখেটেখে যাদু একদিন আমাকে বললো যে, এ রকম হলে কী করে তাঁকে আমি চালিয়ে নেব?আমি বললাম, দেখো জিয়া বক্তব্য দিতে পারেন না ঠিক আছে। তিনি সবচেয় ভালো-ভাবে কী করতে পারেন, সেটা খুঁজে বের করো।

জবাবে যাদু বললেন, হাঁটতে পারেন এক নাগাড়ে ২০ থেকে ৩০ মাইল পর্যন্ত। আমি বললাম এইতো পাওয়া গেল সবচেয়ে ভালো একটা উপায়, তুমি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পাড়াগাঁয়ে হাঁটাও। …. গাঁও গেরামের রাস্তা দিয়ে যাবে আর মানুষজনকে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছেন? প্রেসিডেন্ট দেশের মিলিটারী লিডার, তিনি গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কানাকানচি দিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন আর লোকজনের ভালো-মন্দের খোঁজ খবর করছেন, তাতেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন।

মোখলেসুর রহমানের ভাষ্য হচ্ছে, এভাবে দেখতে দেখতে জিয়াউর রহমান বক্তব্য দেয়াটাও রপ্ত করে ফেললেন। যেখানে কোনদিন ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানও যাননি, সেখানে খোদ দেশের প্রেসিডেন্ট যাচ্ছেন। সেটা এক বিশাল ব্যাপার।

“এসব দেখে গ্রামের লোকজন ভাবল, জিয়াউর রহমান এমন লোক, যিনি আমাদের খোঁজ খবর রাখেন,” মোখলেসুর রহমানের সাক্ষাতকার এভাবেই উঠে এসেছে মহিউদ্দিন আহমদের বইতে।

১৯৭৮ সালের ২৮শে এপ্রিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করা হলো। জুন মাসে অনুষ্ঠিত সে নির্বাচনে জিয়াউর রহমান ৭৬.৩৩ ভাগ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভায় ‘সিনিয়র মিনিস্টার’ নিয়োগ করা হয়।

জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গ্রুপের একটা প্ল্যাটফর্ম।তাঁদের একতার একটাই ভিত্তি ছিল, তারা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এককাট্টা। নানান মত ও পথের এ ফ্রন্ট নিয়ে জিয়াউর রহমান স্বস্তিতে ছিলেন না। তিনি ‘একমনা’ লোকদের নিয়ে আলাদা দল তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন।

দল তৈরির জন্য যাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছিল, তাঁদের অন্যতম ছিলেন তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী। তিনি দলের নাম ‘জাস্টিস পার্টি’ রাখার প্রস্তাব করেন। নামটি কিছুটা পানসে হওয়ায় সেটি গ্রহণযোগ্য হয়নি। দলের নামের সাথে জাতীয়তাবাদী থাকাটা জরুরী ছিল। শেষমেশ স্থির হয়, দলের নাম হবে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’। জিয়াউর রহমান নিজেই দলের নামকরণ করেছিলেন।

১৯৭৮ সালের ২৮ আগষ্ট ‘জাগদল’ বিলুপ্তির ঘোষণা দেন।

১লা সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বিএনপির প্রধান হিসেবে দলের নাম, গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচী আনুষ্ঠানিক দল ঘোষণা করেন।

বিএনপির গঠনতন্ত্র তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন নয়জন । তাদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছাড়া যুক্ত ছিলেন বিচারপতি সাত্তার, নাজমুল হুদা, মওদুদ আহমদ এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী অন্যতম।

গবেষক মহিউদ্দন আহমদ তাঁর বইতে লিখেছেন, বিএনপি এমন একটি দল, যার জন্ম স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। এই অঞ্চলে সব দলের জন্ম হয়েছে ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে, রাজপথে কিংবা আলোচনার টেবিলে। বিএনপি সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। দলটি তৈরি হলো ক্ষমতার শীর্ষে থাকা একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তির দ্বারা, যিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি রাজনীতি করবেন।

(লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের বই ‘বিএনপি সময়-অসময়’ থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা হয়েছে। প্রথমা প্রকাশন থেকে ২০১৬ সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছে।)

বিএনপির স্ট্যান্ড ‘নো খালেদা নো ইলেকশন’

নির্বাচন নিয়ে চরম অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতার যোগ বিয়োগ কষছে আওয়ামী লীগ। অপর দিকে আদৌ নির্বাচন হবে কি না, অথবা খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হবে কি না, সেই দোলাচলে আছে বিএনপি। দেশে এবং বিদেশে নানা ধরনের মেরুকরণের খবর আসছে। বিএনপির স্ট্যান্ড ‘নো খালেদা নো ইলেকশন’।

অর্থাৎ খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রেখে জাতীয় নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। এর কারণ, নিশ্চিত একটি বিজয়কে নস্যাৎ করতে দেয়া যায় না। ইতোমধ্যেই জন রব উঠেছে বিএনপি ক্ষমতায় যাচ্ছে। খোদ আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা আড়ালে আবডালে এসব কথা বলছেন।

সত্যি সত্যি যদি একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় তাহলে বিএনপির বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। আরো একটু খোলাসা করে এভাবে বলা যায়, মানুষকে যদি ভোট দিতে দেয়া হয় তাহলে কোনোক্রমেই কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের বিজয়ের সম্ভাবনা নেই। একজন রিকশাওয়ালা, উত্তরবঙ্গে তার বাড়ি।

তার ধারণা মানুষ ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে। একটু সুযোগ পেলেই তাদের রাগ ক্ষোভ ও ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটবে। তার ভাষায় যদি এটুকু নিশ্চিত করা যায় যে, পুলিশ গুলি করবে না তাহলে দেখবেন মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। সে পলিটিক্স বোঝে না কিন্তু এটা বুঝে, শুধু র‌্যাব পুলিশ এতদিন তাদের টিকিয়ে রেখেছে। এটা যদি সাধারণ মানুষের বক্তব্য হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য তা অশনি সঙ্কেত। আওয়ামী-শিবির আর তাদের রণকুশলীরা তাই পরাজয়কে ঠেকিয়ে ক্ষমতায় থাকার ফন্দি ফিকির আঁটছে।

নির্বাচনের আগে বিএনপি যদি তীব্রতর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, তাহলে ক্ষমতাসীনদের শক্তি-সামর্থ্য ও সমর্থন ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসবে। তখন নিশ্চিত পরাজয় ঠেকানোর জন্য সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে ক্ষমতায় বহাল থাকার একটি চিন্তা শাসক মহলে রয়েছে।

যেসব দেশে স্বৈরাচার জেঁকে বসেছে, সেসব দেশে নির্বাচন না দিয়ে জাতীয় সংসদের মেয়াদ বাড়ানোর উদাহরণ রয়েছে। আরেকটি হচ্ছে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে আরো শক্তি প্রয়োগ আরো নির্মমতা প্রদর্শন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা। যদি অবস্থা এরকম হয় যে, নিজেরা আর ক্ষমতায় থাকার মুরোদ নেই তখন ফখরুদ্দীন জাতীয় পদার্থের আমদানি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জরুরি অবস্থা সরকারের দুটো কাঠামো নিয়ে চিন্তা করছেন।

প্রথমটি আওয়ামী লীগের পরোক্ষ সমর্থনে অপরটি আওয়ামী বিরোধীদের সমর্থনে। ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথম দিকে বিএনপির আশীর্বাদপুষ্ট হলেও অবশেষে আওয়ামী লীগের পকেটে চলে যায়। এবারো বিষয়টি বুমেরাং হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রফেসর ইউনূসের বদলে বিতাড়িত প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বিরোধীদের সমর্থন পেতে পারেন।

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin