জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচার কিছুক্ষণের মধ্যে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে শুরু হতে যাচ্ছে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সেখানেই রয়েছেন । বুধবার সকালে কারাগারের চারপাশে পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়।। কিছুক্ষণের মধ্য বিচারক প্রবেশ করবেন বলে পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন।
কারাগারেই বিচার খালেদা জিয়ার
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারে আজ বুধবার পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে যেখানে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রয়েছেন সেখানেই বসছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নিরাপত্তার কারণে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা বিচারের শেষ পর্যায়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন চলছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ খালেদা জিয়াকে ৫ বছর কারাদণ্ড দেয়ার দিন থেকে তিনি এই কারাগারে রয়েছেন। প্রজ্ঞাপন জারির আগে গতকাল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আইন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করছে বলে সাংবাদিকদের জানান।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচার কার্যক্রম বকশিবাজার এলাকার সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে অস্থায়ী আদালতে পরিচালিত হচ্ছে। এ মামলার বিচার কার্যক্রম চলাকালে এলাকাটি জনাকীর্ণ থাকে বিধায় নিরাপত্তাজনিত কারণে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯ (২) ধারার ক্ষমতাবলে সরকার বিশেষ জজ আদালত ৫ এ বিচারাধীন বিশেষ মামলা নং ১৮/২০১৭ এর বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ঢাকা মহানগরের ১২৫ নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের কক্ষ নং ৭ কে অস্থায়ী আদালত হিসেবে ঘোষণা করল।
এবং ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৫ এ বিশেষ মামলা নং ১৮/২০১৭ (জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা) বিচার কার্যক্রম পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের কক্ষ নং ৭ এর অস্থায়ী আদালতে অনুষ্ঠিত হবে।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী সিনিয়র অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়Ñ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অর্থ সংগ্রহ করেন। এখানে সরকারের কোনো অর্থ নেই। বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ সাত মাসের বেশি সময় নির্জন কারাগারে আছেন। তিনি গুরুতর অসুস্থ। জেল কর্তৃপক্ষ অসুস্থতার কারণে তাকে আদালতে উপস্থিত করতে পারেনি।
সরকার চরম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তড়িঘড়ি করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাজা দেয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে শারীরিক অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে বিচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে কারাগারে বিচারের নজির নেই। এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেন, আমরা গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়াকে কারাগারে বিচার করার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, এই মামলায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া কি এমন মধু আছে যে তাড়াহুড়া করে কারা অভ্যন্তরে বিচার করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, জেলের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করতে আমরা কখনো দেখিনি। বিচারব্যবস্থায় এমন ঘটনা, যা কেবল বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে ঘটছে। খালেদা জিয়া আইনগতভাবে বিচার পাক তা সরকার চায় না। তারা সব কিছুই রাজনৈতিকভাবে করছে। জয়নুল আবেদীন আরো বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে সরকার রাজনীতি করছে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাকে দীর্ঘদিন জেলে রাখতে চায় সরকার। এ জন্য তিনি যাতে আইনগতভাবে মুক্তি না পান সে জন্য নি¤œ আদালত নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। খালেদা জিয়া প্রকৃত বিচার পাক তা তারা চায় না। কারাগারে বিচার শুরু হলে আইনজীবী হিসেবে তাতে অংশ নেবেন কি না প্রশ্নের জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করা হলে তা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।
খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানি না। তবে কারাগারে আদালত বসলে সেটি আইনের পরিপন্থী হবে। এর আগে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। কারাগারে আদালত বসলে সেখানে তারা যাবেন কি না প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুনানি যেখানেই হোক, খালেদা জিয়ার আইনজীবী হিসেবে আমাদের সেখানে উপস্থিত থাকতেই হবে।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, এটি আইন ও সংবিধান পরিপন্থী। আইন অনুযায়ী আদালত এমন স্থানে হবে যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশের অধিকার থাকবে। জেলের ভেতরে সাধারণের প্রবেশের অধিকার নেই। কারা অভ্যন্তরে খালেদা জিয়ার বিচারে আদালত বসানোর গেজেট বেআইনি এবং সভ্য সমাজের পরিপন্থী।
এ বিষয়ে বিএনপির আইন সম্পাদক ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেকোনো নাগরিকের বিচার হতে হবে প্রকাশ্য আদালতে। যেখানে বাদি-বিবাদীদের আইনজীবী, সাংবাদিক এবং মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকতে পারেন। অর্থাৎ জনসাধারণের প্রবেশের সুযোগ আছে এমন আদালতে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে জেলখানার মধ্যে যে আদালত বসানো হচ্ছে তা ক্যামেরা ট্রায়াল হিসেবে বিবেচিত হবে। সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সরকার কারাগারে এই ট্রায়ালের ব্যবস্থা করছে; যা সংবিধান ও প্রচলিত আইনের বিরোধী।
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বুধবার একটি আদালত বসার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই আদালতে মামলা পরিচালনা করতে পারব বলে আমরা মনে করছি। তিনি বলেন, মামলাটিতে ৩২ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্কও হয়েছে। খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে বাকি কিছু বক্তব্য শোনার পর আদালত এই মামলার রায়ের জন্য তারিখ নির্ধারণ করবেন বলে আশা করছি। তিনি বলেন, কারাগারে আদালত বসানোর বিষয়ে আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় আছি। গেজেট প্রকাশ হলেই কারাগারে শুনানি শুরু হবে।
গত ৭ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আগামী ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছেন আদালত। একই সাথে এ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি ওই তারিখ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। রাজধানীর বকশিবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. মো: আখতারুজ্জামান ছুটিতে থাকায় ভারপ্রাপ্ত বিচারক শেখ নাজমুল আলম যুক্তি উপস্থাপনের নতুন তারিখ ধার্য করে এবং জামিন বর্ধিত করেন।
৭ আগস্ট মামলাটির যুক্তি উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য ছিল। তবে কারাগার থেকে খালেদা জিয়াকে হাজির না করে কাস্টডি ওয়ারেন্ট পাঠান কারা কর্তৃপক্ষ। কাস্টডিতে লেখা হয়, খালেদা জিয়া আজ শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাই তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। অপর দিকে খালেদা জিয়ার জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তার পক্ষে আইনজীবীরা জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করেন।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আসামি চারজন। খালেদা জিয়া ছাড়া অন্য তিন আসামি হলেনÑ খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএর নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
গত ১ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় আসামি জিয়াউল হক মুন্নার পক্ষে যুক্তিতর্কের শুনানি শুরু হয়। এ মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে এখনো যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়নি।
২০১১ সালের ৮ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি দায়ের করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ বিচারক বাসুদেব রায় এ মামলার অভিযোগ গঠন করেন।