‘চলমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়’

আসন্ন জাতিয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দি ঢাকা ফোরামের গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের উপাদানগুলো অনুপস্থিত। দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। বিচার বিভাগকে সরকার কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তা সাবেক প্রধান বিচারপতির কথায় স্পষ্ট হয়েগেছে। খেলার আগেই প্রতিপক্ষের হাত-পা ভেঙ্গে দিচ্ছে।

রেফারি কে হবে, খেলার ফলাফল কি সেটাও নির্ধারণ করছে সরকার। চলমান এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানায় সংগঠনটি। শনিবার সকাল ১০ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

গোলটেবিল বৈঠকে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতার ব্যবহার করতে দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই সকলের প্রত্যাশা প্রধান রাজনৈতিক দলের উচিত আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়া। তা না হলে জাতি গভীর অন্ধকারে নিপাতিত হতে পারে যা মুক্তি যুদ্ধের মহান শহীদদের রক্তের প্রতি অবমাননা করা হবে।

ওই গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক আমলা, কূটনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা ফোরামের চেয়ারম্যান ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সমগ্র জাতি ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির আশংকায় উৎকণ্ঠিত। গণ মানুষের এ এ আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিলে তা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। প্রবন্ধে আরও বলা হয়, বর্তমান সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বহাল রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার বিষয়ে অনড়। অর্থাৎ দলীয় নেত্রীকে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসেবে বহাল রাখতে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সরকারি দল ইতিমধ্যে এই লক্ষ্যে পুলিশ ও জনপ্রশাসন বিভাগের রাজনীতিকরণ সম্পন্ন করেছে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে। যদি এটি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এমন আশঙ্কা অমূলক নয় যে গায়েবী, মিথ্যা মামলা, গুম আর অপহরণের মতো বিষয়গুলো আরও প্রকটতর হবে।

দুটি বিষয় ভোটাধিকার পুনরূদ্ধারের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণকে আশান্বিত করেছে বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটি হলো- অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু পরিবর্তন। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ভারতসহ অন্যান্য দেশ ও সংস্থাসমূহের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন। দেশজ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে অনু:সৃত বিরোধী বৃত্তের বাইরে তৃতীয় একটি শক্তির উত্থান হয়েছে।

এই শক্তিটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য কাজ করেছে। এই মোর্চাটি আওয়ামী লীগের ২০০৯ ও ২০১৪ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করেছে কিভাবে সরকারি প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে যা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। এটি বেগম জিয়ার জামিন সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনার অপচেষ্টা মাত্র।

বাংলাদেশ ইস্যুতে বহির্বিশ্বের অবস্থান বদলেছে দাবি করে প্রবন্ধে বলা হয়, অতীতে আওয়ামী লীগের দেয়া যুক্তি বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দেওয়া মানে ‘তথ্য কথিত’ ইসলামী সন্ত্রাসকে উষ্কে দেয়া যা আন্তর্জাতিক বিশ্ব অনেকটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতিতে আজ নেই। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাম্প্রতিক সফরে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়।

বাংলাদেশে প্রাক্তন ভারতীয় হাই কমিশনার ও অন্যান্য কিছু সাংবাদিক ও কূটনীতিক একই মত ব্যক্ত করে গেছেন। বর্তমান হাই কমিশনারও একাধিকবার একই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।

বৈঠকে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নেই উল্লেখ করে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, তফসিলের পর ৪৫ দিনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অসম্ভব। একটি রাজনৈতিক দল দুই বছর থেকে ভোট চেয়ে জনসভা করে বেড়াচ্ছে। আরেকটি দলকে জনসভার অনুমতিই দেয়া হচ্ছেনা। ইসির উচিত ছিল ভোটের অন্তত ৯০ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করা।

সিইসির দেয়া প্রতিশ্রুতির উল্লেখ করে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সিইসি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৫ই জানুয়ারির মতো আর কোনো নির্বাচন হবে না। ১৯৯৬ সালে সিইসির দলীয় ও নির্দলীয় দুই রকম সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ইসিকে তাই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, সুশীল সমাজের কাজ হচ্ছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। সেই সুশীল সমাজও বিভক্ত হয়ে গেছে। মামলা, মোকদ্দমা, গুম খুনের কারণে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে দেশে। এই পরিবেশ অব্যাহত থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। পাশাপাশি নির্বাচন উপলক্ষে সরকার যেভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করছে তাও অনৈতিক। এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয় আদৌ আছে কিনা তা যাচাই করা দরকার।

বর্তমান ইসি সন্দেহজনক কার্যকলাপ করছে অভিযোগ করে সাবেক এই মহা হিসাবনিরীক্ষক বলেন, ইভিএম প্রকল্প পাসের আগে ইসি তা কেনার জন্য এলসি খুলেছে। ইসির তো আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। সেসব বাদ দিয়ে তারা ইভিএমের পেছনে লেগে আছে। মুখে বক্তৃতা দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন সংবিধানেই আছে উল্লেখ করে এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন দিলে বেআইনি কিছু হবেনা। এমপিরা অলিখিতভাবে অনেক প্রভাবশালী। সংসদ রেখে নির্বাচন করলে নানা সমস্যা দেখা দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সমাপনী বক্তব্যে বলেন, একাত্তর সালের মতো বাংলাদেশ একটি মৌলিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। গতানুগতিক নির্বাচন করে কেউ যদি তিন চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেয় সমস্যার সূত্রপাত হবে সেই সময় থেকে। আমরা স্বল্প সময়ে কিছু করতে পারবনা। তিনি বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে সংসদ না ভেঙ্গে নির্বাচন না করলে ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন হবে না। এবার সমস্যাকে কার্পেটের নিচে ঠেলে দেয়া যাবে না। যারা ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র তারা জানে এটা বিস্ফোরণ করে। তাই যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করা দরকার। গতানুগতিক একটা নির্বাচন হলেই হলে হবেনা- সেই উদ্বেগ আমরা প্রকাশ করছি। এখানে কিছু করার থাকলে করতে হবে, নাহলে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

সালেহ উদ্দীন বলেন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে ১৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম। জিডিপি জিএনপিসহ নানা সূচকে উন্নতি হচ্ছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে ফাকি রয়েছে। এই উন্নতির কোন মানে নেই। এর মাধ্যমে দেশের প্রকৃত উন্নতি প্রতিফলিত হয়না। আইনের শাসনের কোন বিকল্প নেই। ভোট দিতে পারাই এখন জনগণের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার পরিবেশ না পেলে কিভাবে ভোট দিবে প্রশ্ন রাখেন তিনি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতাও সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত। কিন্তু সেই সংবাদপত্রকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে। দেশের বিচারবিভাগের কি অবস্থা তা সাবেক প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে বোঝা যায়। এই পরিবেশে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক আরও বলেন, দেশে সাংঘাতিক সংকটময় পরিবেশ বিরাজ করছে। এখানে সুশীল সমাজও আপোস করে চলছে। সরকারের যেভাবে দমন নীতি গ্রহণ করেছে তাতে করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। এজন্য সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সত্যিকার ভোটে নির্বাচিত সরকারের কর্মকা- ভাল হয়। ভুয়া ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাজ ভাল হয় না। যে সরকার প্রশাসন, পুলিশের মাধ্যমে ভোটে জিতে তারা জনগণকে খুশি করার বদলে পুলিশ ও প্রশাসনকেই খুশি করে। আর জনসমর্থন না থাকায় তারা জনগণের প্রতি প্রতিশোধ নিতে চায়।

ড. আসিফ নজরুল আরও বলেন, সরকারের ক্ষমতা হারানোর ভীতি থাকলে দু:শাসন কম হয়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল বলে ভালভাবে শাসন করেছে। কিন্তু ২০১৪ সালের পরবর্তী পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এই আমলে জনগণকে প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি।

বিরোধী দলকে সরকার নানাভাবে দম করছে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল আরও বলেন, গায়েবি মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কের কারণে বিরোধী নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পারছেনা। তাদের জনসভা করতে দেয়া হচ্ছেনা। সাধারণ মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। নির্বাচন যতই সামনে আসে সরকার ততই দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। জামিনযোগ্য অপরাধে মামলার পরও ব্যারিস্টার মইনুলকে জামিন দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে ইউএসএইড বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসন বিষয়ক ডেপুটি অফিস ডিরেক্টর সেøভিকা রডোসেভিক বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুশীল সমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের এই আলোচনা ও সংলাপ অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বৈঠকে সাবেক রাষ্ট্রদূত এফ এ শামীম আহমেদ, মাহমদুর রেজা চৌধুরী, ইফতেখারুল করিম, মাসুদ আজিজ, শাহেদ আখতার, পানি বিশেষজ্ঞ ম ইনামুল হক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুজাহেরুল হক, জাপার এমপি ফখরুল ইমাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সূত্র: নয়া দিগন্ত

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin