khaleda_kamal-45

খালেদা জিয়া-কামাল সাক্ষাতে ঐক্যফ্রন্টের অমীমাংসিত জট খুলবে?

কারান্তরীণ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনসহ ফ্রন্টের শীর্ষনেতারা। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠকে নেতারা এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হয়েছেন। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতারা আশা করছেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সম্ভাব্য এই সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে চারদলীয় এই ফ্রন্টে চলমান অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান হবে। 

সোমবার (২১ অক্টোবর) বিকালে ফ্রন্টের অন্যতম নেতা আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের রব জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে সাক্ষাতের দিনক্ষণ এখনও ঠিক হয়নি। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে গত বছরের ১৩ অক্টোবর বিএনপি যুক্ত হলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনে কামাল হোসেনের অংশ না নেওয়া, নির্বাচনের পর বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গণফোরামের এ সভাপতিকে ‘দলীয় মতাদর্শভিত্তিক’ বক্তব্য দিতে চাপ দেওয়াসহ ফ্রন্টের সিদ্ধান্ত নিয়ে শরিক দলগুলোর মধ্যে নানারকম ‘সন্দেহপূর্বক সহাবস্থান’ তৈরি হয়।

নির্বাচনের পর কর্মসূচি নিয়ে শরিকদের আন্তরিকতা থাকলেও বিএনপির অনীহা এবং দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে কামাল হোসেনকে নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন ওঠে।

ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কামাল হোসেন তো কখনও ‘না’ করেননি যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করবেন না। তার সঙ্গে কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে ভুল বোঝাবুঝি কমবে। একটা নমনীয় ভাব তৈরি হয়েছে সবার মধ্যে।’

বিএনপির প্রভাবশালী একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, দলের স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি থেকে সরে আসার পর প্রকাশ্যেই বিএনপির মাঝারি স্তরের কয়েকজন নেতা জোটের কার্যকারিতা ও রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে নানারকম সমালোচনা করেন। ওই সময় চূড়ান্তভাবে অভ্যন্তরীণ বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং ঐক্যে ‘সর্বনাশ’ ঘটায়।

এ বিষয়গুলোর স্পষ্ট কোনও ব্যাখ্যা তৈরি না হওয়াকে কেন্দ্র করে ঐক্যফ্রন্টে এখনও পুরোপুরি আস্থা তৈরি হয়নি। পরে এই দুই নেতা না যাওয়ায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ড. আবদুল মঈন খানকে ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিতে বলেন। যদিও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় একদিনও তাতে অংশগ্রহণ করেননি।

জানতে চাইলে ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘বিষয়টি ঠিক সেই রকম না। আসলে ঐক্যফ্রন্টে আমাদের (বিএনপির) স্থায়ী কোনও প্রতিনিধি ছিল না। আগে আমরা তিনজন যেতাম। মাঝে কিছুদিন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান যেতেন ফ্রন্টের সভা-সমাবেশগুলোয়। এখন ইকবাল হাসান ফ্রন্টে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন। আবার প্রয়োজন অন্য কেউ যেতে পারেন। ফ্রন্টে আমাদের প্রতিনিধি যায়, এটা সাধারণ বিষয়।’ একই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক পক্ষ বলছে, বিএনপির শীর্ষনেতৃত্ব জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন। আগামী দিনের রাজনীতিতে ফ্রন্টকে ‘সেন্টার-পয়েন্ট’ হিসেবে ধরে এগুনোর বিষয়ে শীর্ষনেতৃত্ব আন্তরিক। আর সংসদে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবেই এ বিষয়ে কামাল হোসেনকে বার্তা দেওয়া হয়। বিশেষত, গত নির্বাচনের পর সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে গণফোরামের সুলতান মুহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খান সংসদে যোগ দেওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েন কামাল হোসেন। রাজনৈতিক চাপে মোকাব্বির খানকে বহিষ্কার করলেও পরবর্তীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নাটকীয়ভাবেই দলীয় বিজয়ীদের সংসদে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেন। এই নির্দেশে দলের অখণ্ডতা যেমন রক্ষা হয়েছে, তেমনি ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়কের জন্যও স্বস্তিদায়ক ছিল।

দায়িত্বশীল এই পক্ষের যুক্তি, বিভিন্ন সময় জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলাকে কেন্দ্র করে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের ওপর বিএনপির একটি ছোট অংশের মাঝারি মানের নেতারা কর্মীদের নিয়ে চাপ তৈরির চেষ্টা করলেও আদতে ফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে বিএনপির একটি ‘আদর্শিক ও বিশ্বাসগত’ দূরত্ব থাকবেই। এই বাস্তবতা ধরে রেখে ফ্রন্টকে সক্রিয় রাখাতেই রাজনৈতিক সাফল্য দেখছে বিএনপির শীর্ষনেতৃত্ব। এরইমধ্যে গত কয়েকদিনে বিএনপির দ্বিতীয় সারির কোনও-কোনও নেতা ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টিকে ইস্যু করে ফ্রন্ট নেতাদের বক্তব্য দেওয়ার পরামর্শ দেন। এ প্রচেষ্টা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে গুরুত্ব না পাওয়ায় বন্ধ করতে হয়েছে। 

এ বিষয়ে ফ্রন্টের নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বিএনপির কিছু লোক সরকারের ক্যাম্পেইনের সহযোগিতা করে। এই ঐক্যফ্রন্টে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে বিএনপির। এটা তো তাদের বুঝতে হবে। আমাকেও বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়েছে, তারা জামায়াতকে যেভাবে নিয়ে চলছে, আমরা তো তা করবো না। সব তো আমাদের এক হবে না। তাদের কিছু নেতা মাঠে নামে না, তাই অজুহাত তৈরি করে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের ঘনিষ্ঠ একাধিক দায়িত্বশীল বলছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষনেতৃত্বের কৌশলগত মিল না হলে এই ঐক্য টেকসই হবে না। তারেক রহমানের বিষয়ে মনোনয়ন বিতরণসহ একাধিক আপত্তি থাকলেও রাজনৈতিক কৌশলগত বিষয়ে গত দেড় বছরে তার সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর হয়েছে এবং ফ্রন্টের স্বার্থে বিঘ্ন ঘটেনি।

ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে বিএনপির শীর্ষনেতৃত্ব, স্থায়ী কমিটি ও ফ্রন্টের নেতৃত্বে আরও আস্থা তৈরি হবে। বিশেষ করে সমন্বিত মনোভাবের ভেতর দিয়ে সৃষ্টি হবে ভবিষ্যতের রোডম্যাপ। সাক্ষাতে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, সরকারের আচরণ পর্যালোচনা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিও বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে উঠতে পারে। এছাড়া, নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তিকে ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত করার একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই ব্যক্তিরা ফ্রন্টে যুক্ত হলে কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া আরও বেগবান হবে, এমন প্রত্যাশা রয়েছে ফ্রন্টের প্রায় সবপক্ষের। আর তা খালেদা জিয়ার নজরে আনার সুযোগ নেবেন কোনও নেতা, বলে জানায় কোনও-কোনও সূত্র। সর্বোপরি খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য, তার বিদেশে চিকিৎসাগ্রহণের বিষয়টি নিয়েই প্রকাশ্যে বক্তব্য দেবেন ফ্রন্টের নেতারা।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক একটি দলের প্রধান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে তো একটা আলোচনা আছেই। বিশেষ করে ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হচ্ছে, আন্তরিকতা নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরা ভাবলাম, খালেদা জিয়া নিজে খুব অসুস্থ এবং নেতাকর্মীরা নিশ্চয় এর থেকে আশ্বস্ত হবেন, ঐক্যফ্রন্ট তাদেরই জোট। এতে করে পরবর্তী মুভমেন্ট সমন্বিত উপায়ে করা সহজ হবে।’

জানতে চাইলে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘আমরা মানবিক কারণে খালেদা জিয়াকে দেখতে যাবো। আর কামাল হোসেনসহ নেতারা তাকে দেখতে যাবেন, এই বিষয়টি আলোচনায় আসার পর থেকেই অভ্যন্তরীণ প্রশ্নগুলো কেটে গেছে। কতগুলো প্রোগ্রাম গ্রহণ করার কারণে ঐক্যফ্রন্টের সামান্য সমস্যা ছিল, সেগুলো কেটে গেছে।’

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সমাজের বিশিষ্টব্যক্তিদের ফ্রন্টে যুক্ত করার ব্যাপারে আলোচনা করেছি। বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসার পর বিষয়টি চূড়ান্ত করবো।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনও সময় কোনও টানাপোড়েন ছিল না। শুরুতে যেভাবে ছিল, এখনও সেভাবেই আছে।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার একটি সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই সমাবেশে ফখরুল বলেছিলেন, জাতীয় ঐক্য করতে কারাগার থেকে সম্মতি দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া।

স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য আবদুল মালেক রতন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মির্জা ফখরুল সাহেবের সঙ্গে কথা বলেই বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি ঠিক করেছি। তিনি সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল আছেন।’

বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, গত ৪ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে যান বিএনপির মহাসচিব। সেখানে তিনি চিকিৎসাগ্রহণ করে অস্ট্রেলিয়া যান। এখন তিনি সেখানেই আছেন।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin