খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত কেউ নেই বিএনপিতে?

বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেন অনেকটা নাটকীয়ভাবে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর প্রথমে বিএনপির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। কিন্তু আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে বিএনপি ক্রমশ সঙ্কুচিত এবং বিভক্ত হতে থাকে।

এরকম পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরার জন্যে বিএনপির একটি অংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিল। সেই সময় বেগম খালেদা জিয়া কিছু মানুষের উপর বিশ্বাস এবং আস্থা রেখেছিলেন। যারা সেসময়ে বেগম খালেদা জিয়াকে পরিচালিত করতেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত বিশ্বস্ত লোকের পরিবর্তন হল।

কয়েকজন মানুষ ছিল যারা বেগম খালেদা জিয়ার সার্বক্ষণিক বিশ্বস্ততার এবং নির্ভরতা হিসেবে দলের ভেতর ছিলেন। এই কারণে তারা দলে প্রভাবশালীও ছিল। কিন্তু এখন বেগম খালেদা জিয়া যখন রাজনীতি ত্যাগের মুহুর্তে এবং রাজনীতি করতে অনাগ্রহী তখন দেখা যাচ্ছে যে, বেগম খালেদা জিয়া যাদের উপর নির্ভর করতেন এবং যাদের কথায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতেন, তারা আসলে এখন কেউ-ই বিএনপিতে নেই বা বিএনপিতে থাকলেও নীতিনির্ধারনী জায়গায় নেই।

বেগম খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত লোকদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের মধ্যে যেমন ছিলেন সাইফুর রহমান, মেজর জেনারেল (অবঃ) এম মজিদ উল হক, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল অবসরপ্রাপ্ত মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। কিন্তু এরা চলে যাওয়ার পরও বেগম খালেদা জিয়ার একটি বিশ্বস্ত নীতিনির্ধারণী নেতাদের একটি দল ছিল যাদের কাছ থেকে বেগম খালেদা জিয়া বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিতেন।

এদের মধ্যে কর্ণেল অলি আহমেদ খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে দলত্যাগ করেছেন। অনেকে মনে করেন যে, কর্ণেল অলি আহমেদের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার বিরোধের মূল কারণ তারেক জিয়া। তারেক জিয়ার কারণেই কর্ণেল অলি শেষ পর্যন্ত বিএনপি ছেড়েছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় বেগম খালেদা জিয়া তরুণদের নিয়ে একটি বিশ্বস্ত বলয় তৈরি করেছিলেন। যাদের উপরে অনেককিছু নির্ভর করতো এবং যারা বেগম খালেদা জিয়াকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করতে পারতো। এদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল মোসাদ্দেক আলী ফালু, ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা, মির্জা আব্বাস, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াঁ, আবদুল্লাহ আল নোমানের মতো নেতারা এবং এরাই বেগম খালেদা জিয়ার ‘কিচেন এডভাইজার’ বলে বিএনপিতে বলা হতো। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসার পর তারেক যুগের সূচণা হয় বিএনপিতে এবং তখন আস্তে আস্তে খালেদার বিশ্বস্ত গ্রুপ দলের ভেতরেই কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে।

২০০১ এর নির্বাচনে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি এবং তিনি ছিটকে পড়েন। পরবর্তী পর্যায়ে আবদুল্লাহ আল নোমানের অবস্থাও দলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সাদেক হোসেন খোকা ওয়ান ইলেভেনের আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন।

কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের পর সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে একটি দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার। অনেকেই মনে করেন, এই দুরত্ব তৈরির পেছনেও তারেক জিয়ার ভূমিকা ছিল। তারেক জিয়া খোকার কর্তৃত্ব পছন্দ করতেন না, অন্যদিকে খোকাও তারেক জিয়াকে নেতা বানানোর বিষয়টি ভালোভাবে নেননি।

তবে খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে দলে পরিচিত ছিলেন মোসাদ্দেক আলী ফালু এবং মোসাদ্দেক আলী ফালু এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় বেগম খালেদা জিয়ার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ফালুকে আইন পরিবর্তন করে একান্ত সচিব পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া বিরোধী দলে গেলেও ফালুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা কমেনি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে ফালু বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হলেও এই সময় থেকে বিএনপিতে ফালু কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকেন।

তারেক জিয়ার কারণেই বিএনপিতে ফালুর দুঃসময় শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে রাজনৈতিক সচিব পদ থেকে বাদ দিয়ে আব্দুল মান্নানের ছেড়ে দেওয়া তেজগাঁ-রমনা আসনের এমপি করা হয়। এমপি হয়ে তিনি রাজনীতিতে অন্য সব সাধারণ নেতার মতো থাকলেও বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অটুট এবং এই কারণে বিএনপিতে তাঁর প্রভাব বলয় ছিল।

ওয়ান ইলেভেনের পর বিএনপিতে সর্বশেষ যে কমিটি হয়েছে, সেই কমিটিতে বিএনপিতে যে পদ দেওয়া হয়েছিল সেই পদে ফালু খুশী না হয়ে পদত্যাগ করেন এবং তারপর বিএনপির রাজনীতিতে তার ভূমিকাও নিঃশেষিত হয়ে যায়।

বিএনপির অনেক নেতাই মনে করেন যে, বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতির প্রতি আজকের যে অনাগ্রহ, সেই অনাগ্রহের প্রধান কারণ তার চারপাশে বিশ্বস্ত লোকের অভাব। কারণ বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সবসময় তিনি অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

এই কারণে তাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার লোক নেই এবং সাম্প্রতিক সময়ে একদিকে যেমন তারেকের আধিপত্য বিএনপিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অন্যদিকে বেগম জিয়াও রাজনীতির উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

বাংলা ইনসাইডার

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin