বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন থাকার সময় কোনো মাধ্যমে তার পদের অপব্যবহার করেননি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কোনো অন্যায় প্রভাব খাটাইনি। আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা মনগড়া সাক্ষ্য দিয়েছেন।
তিনি নিরপেক্ষ থাকলে এরকম অনুমাননির্ভর বক্তব্য দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না। তাছাড়া ‘আমি এ ট্রাস্টের সঙ্গে জড়িত ছিলাম’ বলে এ মামলায় কোনো সাক্ষীও বক্তব্য দেননি। রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে অনুমাননির্ভর ও কাল্পনিক অভিযোগে এই মামলার মিথ্যা বর্ণনায় আমাকে জড়ানো হয়েছে। আমাকে, জিয়া পরিবার ও বিএনপিকে হয়রানি করতেই এ মামলাটি করা হয়েছে।
আমি আদালতে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি। ’ বেগম জিয়া গতকাল রাজধানীর বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. আখতারুজ্জামানের আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে সপ্তম ও শেষ দিনের বক্তব্য দিচ্ছিলেন।
অন্যদিকে, রাজধানীর হাই কোর্ট-বঙ্গবাজার ও সচিবালয় সংলগ্ন এলাকায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিকাল তিনটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা শতাধিক বাস-জিপ-প্রাইভেটকার নির্বিচারে ভাঙচুর করে।
পুড়িয়ে দিয়েছে পুলিশের একটি মোটরসাইকেল। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কয়েকটি কাঁদুনে গ্যাসের শেল ছোড়ে। ঘটনাস্থল ও এর আশপাশের এলাকা থেকে ২০ জনকে আটক করে পুলিশ। এদের মধ্যে বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হকও রয়েছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার যুক্তিতর্কের শুনানি ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাফাই সাক্ষ্যের জন্য দিন ধার্য ছিল গতকাল। পরে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আগামী ১৯, ২০ ও ২১ ডিসেম্বর যুক্তিতর্কের শুনানির জন্য পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছে আদালত। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও একই দিনে সাফাই সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
এর আগে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাম দলগুলোর ডাকা হরতালের কারণে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে সময়মতো আদালতে হাজির না হওয়ায় গত ৩০ নভেম্বর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে একই আদালত। একই সঙ্গে আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ বাতিল করে ৫, ৬ ও ৭ ডিসেম্বর যুক্তিতর্কের জন্য দিন নির্ধারণ করে।
তার আগে গত ১২ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনে থাকাবস্থায় একই আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল। দেশে ফিরেই তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। এর পর থেকে প্রতি সপ্তাহেই তিনি আদালতে হাজিরা দিয়ে আসছিলেন। আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন— ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, এ জে মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন।
তার আগে তারা বেগম জিয়ার পক্ষে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিনের আবেদন করেন এবং যুক্তিতর্ক স্থগিত করে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ চেয়ে দুই মামলায় চারটি আবেদন জমা দেন। ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, হরতালের মধ্যে নিরাপত্তাজনিত কারণে খালেদা জিয়া আগের তারিখে সময়মতো আদালতে উপস্থিত হতে পারেননি।
ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনে বাকি বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। অন্যদিকে— দুদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল (গতকাল) মঙ্গলবারই যুক্তিতর্ক শুরুর আবেদন জানিয়ে বলেন, খালেদা জিয়া জামিনের শর্ত ভঙ্গ করেছেন। সুতরাং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তার আর নেই।
শুনানি শেষে বিচারক খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন এবং যুক্তিতর্ক শুরুর আদেশ প্রত্যাহার করে আত্মপক্ষ সমর্থনের বাকি বক্তব্য উপস্থাপনের অনুমতি দেন। তবে ওই বক্তব্য গতকালই শেষ করতে বলেন তিনি। তার পরপরই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে সপ্তম দিনের বক্তব্য প্রদান শুরু করেন বিএনপি প্রধান। বেলা সোয়া ১১টা থেকে বেলা ২টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে তার বক্তব্য রাখেন। এর আগে সকাল সোয়া ১০টার দিকে গুলশানের বাসা থেকে রওনা হয়ে বেলা ১১টা ১০ মিনিটের দিকে তিনি আদালতে পৌঁছেন।
টানা তিন ঘণ্টারও বেশি সময়ের বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, জিয়া অরফানেজের সঙ্গে তিনি কোনোভাবে জড়িত নন। তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ মামলা থেকে বেকসুর খালাস পাওয়ার যোগ্য। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ বানোয়াট ও অপ্রমাণিত।
মামলায় উল্লিখিত দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করে খালেদা জিয়া বলেন, আমি দুদক আইনের তালিকাভুক্ত কোনো অপরাধ করিনি বলে সুস্পষ্ট জানিয়ে মতামত দাখিল করি, তারপরও কোনোরূপ দালিলিক প্রমাণ ছাড়াই মাত্র পনের দিনের ব্যবধানে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করে। অথচ আপনার আদালতে কোনো তথ্য-প্রমাণও উপস্থাপন করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, দুর্নীতির সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই বা ছিল না। আর আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তারাও অসত্য বলেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা বিভিন্ন সময় আমার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মিথ্যা কথা বলেছেন। ওই ট্রাস্টের নামে বগুড়া বা আশুলিয়ায় জমি কেনার সঙ্গেও আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং আমার নামে কোনো হিসাবও খোলা হয়নি। খালেদা জিয়া আরও বলেন, বাদী আমার বিরুদ্ধে তার জবানবন্দিতে বলেছেন— আমার দুই ছেলে এবং আত্মীয় মুমিনুর রহমানকে দিয়ে আমি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করিয়েছি।
একথা আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্যও বলে থাকেন। অথচ এগুলো সব ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও মনগড়া। পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতের বাংলা তরজমা উচ্চারণ করে আদালতে তার বক্তব্য শেষ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
আয়াতের ভাষান্তর হচ্ছে— ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ কর না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম সম্পর্কেই অবগত। ’
তার আগে খালেদা জিয়া আদালতে বলেন, পিডব্লিউ-১ হারুন অর রশীদ দাবি করেছেন, আমি সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলি এবং অপারেট করি। কিন্তু এর সমর্থনে কোনো তথ্য প্রধানমন্ত্রীর দফতর হতে বা সোনালী ব্যাংকের রেকর্ডপত্র হতে উপস্থাপন করতে পারেননি। আমার বিরুদ্ধে কোনো পর্যায়েই অ্যাকাউন্টটির খোলা অথবা অপারেট করার ব্যাপারে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। কাজেই এ জাতীয় সাক্ষ্যের দ্বারা ক্রিমিনাল ব্রিচ অব ট্রাস্টের অথবা ইনট্রাস্টমেন্টের দায়বদ্ধতা আমার ওপরে বর্তায় না।
এদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় পরবর্তী তারিখে বিএনপি চেয়ারপারসনকে আত্মপক্ষ সমর্থনে লিখিত বক্তব্য জমা দিতে বলেছে আদালত। এ মামলাতেও ১৯ ডিসেম্বর তারিখ রাখা হয়েছে। তবে সেদিনও খালেদা জিয়ার পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থনে মৌখিক বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ চাইবেন তার আইনজীবীরা। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা থেকে জানা গেছে, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়।
কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত এক কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি। জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে মামলার বিবরণীতে।
bd-pratidin