জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। এক মামলায় খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য শেষ হয়েছে। অপর মালায় আত্মপক্ষ সমর্থন শেষ পর্যায়ে। ধারণা করা হচ্ছে, শিগগিরই এ দুইটি মামলার রায় হয়ে যাবে। রায় নিয়ে কী ভাবছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা?
নেতাকর্মীদের ধারণা, ওই দুই দুর্নীতি মালায়ই খালেদা জিয়া বেকসুর খালাস পেতে পারেন! তারা মনে করেন এক-এগারো সরকারের আমলে করা মামলা দুইটি সম্পূর্ণভাবে বেআইনি ও উদ্দেশেপ্রণোদিত।
তারা আরো মনে করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও তৎকালীন মইন উদ্দিন ও ফখরুদ্দীন সরকার হয়রানি ও রাজনৈতিকভাবে হেয় করার উদ্দেশে অনেকগুলো মামলা দায়ের করে। একইভাবে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে উদ্দেশেপ্রণোদিতভাবে এসব মামলা দায়ের করা হয়।
ফলে আদালতে মামলা চললেও ন্যায় বিচারের আশা ছাড়ছেন না বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। তারা বলেন, মামলায় যদি সাজাও হয় তাহলে বিএনপির স্থায়ী কমিটি, গুরুত্বপূর্ণ ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা, দলীয় বুদ্ধিজীবী ও সিনিয়র নেতারা পরবর্তী করণীয় নিয়ে বৈঠক করবেন। ওই বৈঠকেই পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হবে বলে জানান একাধিক নীতিনির্ধারকরা।
দলটির একাধিক নেতা আরো মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার হলেও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা একটি মামলাও প্রত্যাহার হয়নি। ফলে আদালত সবদিক বিবেচনা করবে। তারা এ মামলা দুইটিতে বেগম খালেদা জিয় বেকসুরভাবে খালাস পাওয়ার আশা করছেন। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মানবকণ্ঠকে বলেন, নিরপেক্ষভাবে বিচার করা হলে খালেদা জিয়া সম্পূর্ণভাবে খালাস পাবেন। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, দুদক করতে পারেনি।
এদিকে দলটির একাধিক সূত্র জানান, মামলার রায় নিয়ে ভেতরে কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও বিএনরি নেতারা এটিকে সামনে আনতে চাচ্ছেন না। কারণ কি জানতে চাওয়া হলে দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য মনে করেন, এ সরকারের দায়ের করা মামলা হলে আমাদের চিন্তার বিষয় ভিন্ন হতো। তবে সরকার আদালতের ওপর হস্তক্ষেপ করছে বলে মনে করেন এ নেতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই নেতা বলেন, রায়ের আগে আমরা কিছুই বলতে পারব না। কারণ আদালত তার বিচারকার্যক্রম এগিয়ে নিয়েছেন। আমরা এখন দেখব। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ নেতা এও বলেন, সরকার আদালতে যদি হস্তক্ষেপ না করেন এ রায় ঐতিহাসিকভাবে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবর রহমান শামীম বলেন, এক্ষেত্রে আদালত যদি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত না হয়ে মামলার কাগজপত্র, সাক্ষী, তথ্য-প্রমাণ বিবেচনা করেন, তাহলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালাস পাবেন। একই কথা বলেন আত্মবিশ্বাসী দলটির নেতারা। বিএনপি নেতারা এও বলছেন, খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি মামলায় সাজা দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের তরফে হয়ে থাকলে তা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধেই যাবে।
এমনকি এর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর। পাকিস্তান আমলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেক মামলার আসামি করা হয়েছিল এবং কোনো কোনো মামলার রায়ে তিনি সাজাপ্রাপ্ত হলেও শেষ পর্যন্ত তা ওই রাষ্ট্রের সরকারের বিরুদ্ধেই গেছে, এমন উদাহরণ টানেন নেতারা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মানবকণ্ঠকে বলেন, আমার ধারণা, যদি সুবিচার হয়, যেহেতু এই দুইটি মামলায় কোনো শক্ত অভিযোগ নেই, সে জন্য আদালত খালেদা জিয়াকে সাজা দিতে পারবেন না। সঠিক বিচার হলে সম্ভব না। যে কথা বলা হচ্ছে, এতিমের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, এটা তো ঘটেইনি। ম্যাটারিয়ালসের বস্তুগত দিক থেকে যদি বিচার করা হয়, তাহলে সাজা দেয়া সম্ভব হবে না।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, মামলার নানা দিক বিবেচনা করলে খালেদা জিয়া সাজা হওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন নন। এরপরও নিম্ন আদালতের রায় তাদের প্রত্যাশার বিপরীতে গেলে আইনগত এবং রাজনৈতিক- দুই পথেই মোকাবিলা করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ ও দিক-নির্দেশনা নির্ধারণ করতে আগামীতে অনুষ্ঠিতব্য স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতে পারে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুইটি মামলা, মামলায় রায় ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশ কয়েক নেতার সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, আইনগত দিক নিয়ে পরিকল্পনা করছেন দলের বিজ্ঞ আইনজীবীরা। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার জন্য দলের নেতৃত্ব, সাংগঠনিক কাঠামো ও বিদ্যমান গঠনতন্ত্রের আলোকেই বিএনপিকে সংগঠিত করা হচ্ছে। এছাড়া মামলা দুইটির আইনগত ভিত্তি এতটাই দুর্বল যে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে এবং সেটি স্থায়ীও হবে। যার ফলাফল আগামী নির্বাচনে তীব্রভাবে প্রভাব পড়বে।
এদিকে দলীয় সূত্র জানায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দুইটি দুদকের করা। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে মোট ৩৭টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পাঁচটি মামলা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় দুর্নীতির অভিযোগে করা। দুর্নীতির মামলাগুলো এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় করা। বাকি মামলাগুলোয় গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, হত্যা, মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে করা হয়েছে।
মামলা সম্পর্কে জানা গেছে, ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াসহ আরো কয়েকজন আসামি আছেন। এর মধ্যে অন্যতম তার বড় ছেলে তারেক রহমান।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার মানবকণ্ঠকে বলেন, মামলার বিচার যদি আইনের স্বাভাবিক গতিতে যায়, মামলার কাগজপত্র পড়ে যা দেখলাম, তাতে তার জেল হওয়ার কারণ নেই। তবে সম্পূর্ণরূপে আদালতের ওপর নির্ভর করছে। আমার বিশ্বাস খালেদা জিয়া দুইটি মামলাতেই খালাস পাবেন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দীন খোকনের মতে, মামলার সাক্ষী ও প্রমাণে এত দুর্বলতা, তাতে করে খালেদা জিয়ার কোনো সাজাই হবে না। তিনি খালাস পাবেন।
এদিকে, সম্ভাব্য রায় খালেদা জিয়ার পক্ষে না গেলে আইনের পাশাপাশি বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেও মোকাবিলা করবে বিএনপি। এক্ষেত্রে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জনপ্রিয়তার বিচারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি তীব্র হবে বলে অনেক নেতা সতর্ক করেছেন। এ প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, রাজনৈতিকভাবে সাজা দেয়া হলে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করবো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা ছিল প্রমাণসহ। কিন্তু আমাদের ম্যাডামের ক্ষেত্রে তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। ফলে, শাস্তি দিলে আইনি ও রাজনৈতিক- দুটো পথেই মোকাবিলা করবো। খালেদা জিয়ার সাজা হলে তা দলের ওপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে জানতে চাইলে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, কোনো প্রভাব পড়বে না। তাকে সাজা দেয়া হলে আমরা হাইকোর্টে যাবো।
ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়ার বিষয়টি আদালতের ওপর নির্ভর করলে তার কোনো সাজা হবে না। তবে যদি সাজা দেয়া হয়, তাহলে প্রথমত এটা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই যাবে। আর এটা মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক বৈঠকে ঠিক করব, কী হবে।
খালেদা জিয়ার মামলা, এর সম্ভাব্য রায় ও রাজনৈতিক পর্যালোচনা নিয়ে কথা হয় বিএনপির রাজনীতির গভীর পর্যবেক্ষক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি মনে করেন, বিচারক যদি বিবেক অনুযায়ী বিচার করেন, তাহলে খালেদা জিয়া খালাস পাবেন। যদি অন্য জায়গা থেকে হুকুমনামা আসে, তাহলে হুকুমনামা মেনে চলেন, আর খালেদা জিয়া শক্ত পায়ে দাঁড়াতে না পারেন, তাহলে ভিন্ন একটা রায় আসতে পারে।
এর আগে বহুবার খালেদা জিয়া নিজেও বলেছেন, আমার মামলাগুলোয় যেন রকেটের গতি, পেছন থেকে কেউ যেন তাড়া করছে। খুব দ্রুত রায় দেয়ার জন্য অদৃশ্য ইশারা কাজ করছে। দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা বলছেন, সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই রায়ে বেগম জিয়ার সাজা দেয়া হলে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে নতুন করে ভাববে বিএনপি। সরকার চাচ্ছে বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে একটা সাজার রায়, যাতে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন।
অন্যদিকে দলের নেতারা বলেছেন, নির্বাচনে বিএনপি যাবে কি যাবে না তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দলের কোনো ফোরামে হয়নি। এ সিদ্ধান্ত নেবেন বেগম খালেদা জিয়া। তার মামলার রায় দেখে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। নেতারা মনে করছেন, খালেদা জিয়াকে আইনের মাধ্যমে সাজা দিয়ে ক্ষমতা দখলে রাখতে চায় সরকার। কিন্তু খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য করলে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।
মানবকণ্ঠ