আ.লীগপন্থীদের ভরাডুবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেট নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী শিক্ষকদের হলুদ প্যানেলের ভরাডুবি হয়েছে। সিন্ডিকেটের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে চারটি পদের তিনটিতেই হেরেছেন এই প্যানেলের প্রার্থীরা। গতকাল রোববার সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ মিলনায়তনে ভোট গ্রহণ করা হয়।

সিন্ডকেট নির্বাচনে হলুদ প্যানেলের ভরাডুবির পেছনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রার্থী বাছাইয়ে দুর্বলতা, কয়েকজন কনিষ্ঠ শিক্ষকের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং বর্তমান প্রশাসনের কিছু একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত দায়ী বলে মনে করছেন সাধারণ শিক্ষকেরা।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের ছয়টি এবং ফাইন্যান্স কমিটির একটি পদেও গতকাল নির্বাচন হয়। অবশ্য এই দুটি পর্ষদের সব পদে হলুদ প্যানেলের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল এবং ফাইন্যান্স কমিটির মেয়াদ দুই বছর। ভোট গণনা শেষে গতকাল বিকেলে ফলাফল ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল হুদা। নির্বাচনে ৬৬৬ ভোটারের মধ্যে ৬৩২ জন তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।

এবারের নির্বাচনে দুটি প্যানেল অংশ নিয়েছে। এর একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ-সমর্থিত ‘হলুদ প্যানেল’। অন্যটি বিএনপি-জামায়াত শিক্ষকদের সংগঠন স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত শিক্ষক সমাজ ‘সাদা প্যানেল’। এ ছাড়া সিন্ডিকেট নির্বাচনে সহকারী অধ্যাপক পদে হলুদ প্যানেলের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন একজন।

সিন্ডিকেটে অধ্যাপক পদে সাদা প্যানেলের প্রার্থী দর্শন বিভাগের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ২৬ ভোটে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন। সহযোগী অধ্যাপক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মুহাম্মদ সাখাওয়াত হুসাইন প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৩৫ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন। সহকারী অধ্যাপক পদে জয়ী হন হলুদ প্যানেলের বিদ্রোহী প্রার্থী নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এস এম সাদাত আল সাজীব। তিনি হলুদ প্যানেলের মূল প্রার্থীর চেয়ে ১২ ভোট বেশি পান। এ ছাড়া প্রভাষক পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন হলুদ প্যানেলের প্রার্থী ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক সেতু রঞ্জন বিশ্বাস। গত সিন্ডিকেট নির্বাচনেও সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে জয়ী হয়েছিলেন।

শিক্ষকেরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নীতি ও বিধিবিধান সিন্ডিকেটে প্রণয়ন ও নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় নিয়োগ এবং পরীক্ষার ফল চূড়ান্তভাবে সিন্ডিকেট অনুমোদন করে।

ফল বিপর্যয়ের কারণ নিয়ে আওয়ামী লীগপন্থী সাতজন শিক্ষকের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, হলুদ প্যানেলের শিক্ষকনেতাদের মধ্যে কয়েকজনের আচরণ খুবই ঔদ্ধত্যপূর্ণ। এমনকি কনিষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষকও প্যানেলের নীতিনির্ধারণে প্রভাব খাটান। তাঁদের আচরণে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের অনেকেই ক্ষুব্ধ।

এ ছাড়া হলুদ প্যানেল এখন দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর একটি পক্ষ বর্তমান প্রশাসনপন্থী এবং অন্যটি প্রশাসন বিরোধী হিসেবে কাজ করছে। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইউনিসেফের একটি গবেষণা প্রস্তাব কিছুদিন আগে ফিরিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকেরা আওয়ামী লীগ ও বামধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

এ ছাড়া হলুদ প্যানেলের অন্তত ১১ শিক্ষকের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল বর্তমান প্রশাসনের আমলে। আরেক শিক্ষককে ‘তুচ্ছ’ কারণে পরীক্ষা কমিটি থেকে অপসারণ করা হয়। ছাত্রলীগের নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারী অধ্যাপকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিনি বর্তমান প্রশাসনের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় হলুদ প্যানেলের শিক্ষকদের একাংশ ক্ষুব্ধ।

নাম না প্রকাশের শর্তে হলুদ প্যানেলের স্ট্যান্ডিং কমিটির এক সদস্য বলেন, তাঁদের প্যানেলের কোন্দল এখন প্রকাশ্য। যার মাশুল দিতে হয়েছে সিন্ডিকেট নির্বাচনে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রগতিশীল শিক্ষকদের ওপর ‘নিপীড়নমূলক আচরণ’ অব্যাহত রাখলে সামনের নির্বাচনগুলোতে আরও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে হলুদ প্যানেল।

অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছেন হলুদ প্যানেলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ। তিনি বলেন, দলে ৬০০ শিক্ষক রয়েছেন। সবাই একমত হবেন না সেটাই স্বাভাবিক। আর একটি নির্বাচন হলে অনেক কথা ওঠে।

দুটি কারণে নির্বাচনে ভালো ফলাফল করা সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সাদা প্যানেলের আহ্বায়ক অধ্যাপক এম আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে তাঁরা ভালো প্রার্থী দিয়েছেন। এ ছাড়া এখন সবখানে সরকারদলীয় লোকজন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন, এতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সাধারণ শিক্ষকেরা তাঁদের প্রার্থীদের সমর্থন দিয়েছেন।

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin