alig_bnp

আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও সাইলেন্ট মেজরিটি পার্টি

বিভুরঞ্জন সরকারদিন কয়েক আগে হঠাৎ করেই আমার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এলেন। তিনি ঢাকার নিকটবর্তী একটি জেলা শহরে থাকেন। সাংস্কৃতিককর্মী। সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হলেও রাজনীতি সচেতন। রাজনীতি বিষয়ক খোঁজ-খবর রাখেন। সেই সাপ্তাহিক যায়যায়দিন থেকেই তিনি আমার রাজনৈতিক কলাম পড়েন। তখন কলেজের ছাত্র ছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে মিছিলে অংশ নিয়েছেন। এরশাদের পতনের পর দেশের রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু সে আশা পূরণ না হওয়ায় তিনি কিছুটা বেদনাহত কিন্তু হতাশ নন। রাজনীতিকরাই সব নষ্টের গোড়া—এমন ঢালাও অভিযোগের সঙ্গে তিনি গলা মেলাতে রাজি নন। তবে রাজনীতিকদের কোনও দায় নেই, তাও তিনি মনে করেন না।

তার সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে আমি কিছু লিখতে চাইলে তিনি সম্মত হলেও নাম-পরিচয় গোপন রাখতে বললেন। ছোট জাগায় থাকেন, সবার সঙ্গে মিলেমিশেই থাকতে হয়। তার কথায় কেউ আহত বোধ করতে পারেন। কেউবা ভুলও বুঝতে পারেন। সে রকম কিছু হলে তিনি অস্বস্তিবোধ করবেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করেছি, তার অভিমত বা ধারণাগুলো আমি তুলে ধরব, কারও নাম উল্লেখ করে কিছুই লিখব না।

তার কাছে তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থা জানতে চাইলে এককথায় তিনি বলেন, রাজনীতি নেই, আছে দলবাজি ও দলাদলি। আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনও দলের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। বিএনপির কোনও তৎপরতা নেই। নেতারা বেশির ভাগ গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। কেউ কেউ শাসক দলের স্থানীয় কোনও না কোনও নেতার সঙ্গে ভাব-খাতির করে চলছেন। প্রকাশ্যে তৎপর না হলেও গোপনে সক্রিয় আছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি সংগঠন গোছানোর কাজটি বিরামহীনভাবেই করছে। কৌশলে দলীয় সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। কোন সময়ে কী করতে হবে, তার নির্দেশনা দিচ্ছে।

সরকারি দলের সক্রিয়তার ধরন একেবারেই আলাদা। আওয়ামী লীগে এখন চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা কিছু পাওয়ার জন্য। যারা ইতোমধ্যে ‘ভাগ্য’ ফিরিয়েছেন, তারা আরও বেশি পাওয়ার জন্য ব্যস্ত, আর যারা এখনও না-পাওয়ার দলে আছেন, তারা এই বঞ্চনার অবসান কামনা করছেন। কিছু পাওয়ার জন্য তারা এখন বেপরোয়া, মরিয়া। দল নিয়ে, দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কারও চিন্তা নেই। সবার তীক্ষ্ণ নজর, কোথায় কিছু পাওয়ার সুযোগ আছে।

তৃণমূলের রাজনীতির হাল বোঝার জন্য এর চেয়ে আর বেশি কিছু জানার না থাকায় আমি তাকে প্রশ্ন করি, আগামী নির্বাচনের ফল কী হবে? তিনি রেখেঢেকে কথা বলেন না। স্পষ্ট করেই জবাব দিলেন, নির্বাচনটা কেমন হবে, তার ওপর নির্ভর করবে এর ফল। মানুষ যদি ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ইচ্ছায় পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে এবং নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশ নেয়, তাহলে আওয়ামী লীগের খবর আছে।

আমি বলি, এই যে দেশে এত উন্নয়ন হচ্ছে, মানুষ দুই বেলা খেতে পারছে, আয়-রোজগার বাড়ছে, এরপরও জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না?

এবারেও তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, মানুষ শেখ হাসিনাকে যতটা পছন্দ করে, আওয়ামী লীগকে ততটাই অপছন্দ করে। মানুষ মনে করে, তাদের জন্য শেখ হাসিনার দরদ আছে। তিনি চেষ্টা করছেন দেশ ও দেশের মানুষের ভালো করতে। কিন্তু দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা তাকে ডোবানোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে আছে। মানুষ স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগারদের প্রতি বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। তাদের জ্বালায় মানুষ অতিষ্ঠ। স্থানীয় পর্যায়ে কে কী করছেন, কিভাবে ঘুষ-দুর্নীতি হচ্ছে, কে কাকে কিভাবে ঠকাচ্ছেন, কোন কৌশলে কে সরকারি দান-অনুদান ভাগ-বাটোয়ারা করছেন, কোন নিয়োগে কত টাকা লেনদেন হচ্ছে—এ সবই মানুষের জানা। তারা চোখের সামনে সব কিছু দেখছে।

তিনি এটাও বললেন, সাধারণ মানুষ এমনও ভাবেন যে, সুযোগ থাকলে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে শেখ হাসিনাকে জিতিয়ে দিতাম! কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগকে হারিয়ে শেখ হাসিনাকে জেতানোর কোনও সুযোগ নেই। তাই আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সহজ জয়ের কোনও সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তিনি এটাও জানালেন, মুখে মুখে একটা কথা প্রচার হচ্ছে যে, আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে।

দুঃখের বিষয় হলো, এই প্রচারণাটা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে। কাউকে এর প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেকেই একান্ত আলাপচারিতায় ওই প্রচারণার অনুকূলেই মত দেন। তবে, আওয়ামী লীগের মধ্য একটা আত্মবিশ্বাস কাজ করছে, সেটা হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষপর্যন্ত মুশকিল আসান করবেন। আর এক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকবে আওয়ামী লীগ। কিভাবে এটা সম্ভব হবে, সে প্রশ্নের জবাব তাদের জানা নেই।

বিএনপিকে মানুষ কেন ভোট দেবে? এই দল ক্ষমতায় থাকতে কেমন শাসন উপহার দিয়েছিল, তা কি মানুষের মনে নেই? মানুষ কি হাওয়া ভবন, তারেক রহমানের কথা ভুলে গেছে? আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নেতাকর্মী এখন যেমন ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, ঘুষ-দুর্নীতিতে সামিল হচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কি তার পুনরাবৃত্তি রোধ হবে?—আমার এসব প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ এক দলকে টানা একাধিকবার ক্ষমতায় দেখতে চায় না। নেতিবাচক রাজনীতি আমাদের অস্থি-মজ্জায়। পাকিস্তান আমলে আমরা যে ধারায় রাজনীতি করেছি, এখনও সে ধারায় চলছে। মানি না, মানব না। ‘হ্যাঁ’র চেয়ে ‘না’কে আমাদের বেশি পছন্দ। আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি ভালো, এটা হয়তো অনেকেই মনে করেন না বা বিশ্বাস করেন না, কিন্তু যেহেতু তৃতীয় কোনও বিকল্প নেই, তাই মানুষ বিএনপির দিকেই ঝুঁকে পড়ে।

আমাকে নতুন কোনও প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, নির্বাচনের এখনও এক বছর দেরি। কাজেই এখনই চূড়ান্ত ভবিষ্যদ্বাণী করা ঠিক হবে না। আওয়ামী লীগ যদি সাধারণ মানুষের মনোভাব বিবেচনায় নিয়ে এখনই কিছু উদ্যোগ-পরিকল্পনা নেয়, দলের মধ্যে একটু শুদ্ধি অভিযান চালায়, দলের ভেতরের কলহ-কোন্দল মিটিয়ে ফেলতে পারে, তবেই রাজনীতির হাওয়া বদলাতেও পারে। যেহেতু শেখ হাসিনার প্রতি দেশের মানুষের আস্থা-বিশ্বাস-ভালোবাসা অটুট ও অক্ষুণ্ন আছে, সেহেতু শেখ হাসিনাকেই শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। দলের যেসব নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আছে, যারা বিভিন্ন সময় নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, তাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে, প্রয়োজন হলে তাদের ডানা কেটে দিতে হবে।

এখন যারা সংসদ সদস্য আছেন, তাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষের কাছে অপ্রিয়। যারা আওয়ামী লীগকে ‘আত্মীয় লীগ’ বা ‘সুযোগসন্ধানী লীগে’ পরিণত করেছেন, তাদের আগামীতে কোনোভাবেই মনোনয়ন দেওয়া ঠিক হবে না। এই কাজটি দৃঢ়তার সঙ্গে নির্মোহভাবে করতে পারলে শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আস্থা আরও বাড়বে। নেত্রী খারাপদের বিরুদ্ধে—এই বার্তাটা সাধারণ মানুষের কাছে দিতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে। পরিস্থিতি বদলাতে সময় লাগবে না।

তার কাছে জানতে চাই, আওয়ামী লীগ যদি আগামী নির্বাচনে হেরে যায়, তাহলে অসুবিধা কী? আওয়ামী লীগ পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে লম্বা সময় ক্ষমতার বাইরে ছিল, অত্যন্ত প্রতিকূলতার মুখেও দলের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে ক্রমাগত। আর একবার ক্ষমতার বাইরে গেলে ক্ষতি কী? ক্ষমতার চেয়ে ক্ষমতার বাইরের আওয়ামী লীগ বেশি দৃঢ়।

তিনি বললেন, দেখুন, আমি আওয়ামী লীগ করি না। তবে এটাও অস্বীকার করতে পারি না যে, আওয়ামী লীগ দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন একটি অবস্থান তৈরি করেছে, যেখানে এই দলের ক্ষমতায় থাকা না–থাকার সঙ্গে দেশ এবং সাধারণ মানুষের লাভ-ক্ষতি সম্পৃক্ত। আওয়ামী লীগ যদি আগামী নির্বাচনে পরাজিত হয় এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে ক্ষতি শুধু আওয়ামী লীগের হবে না, দেশেরও সর্বনাশ হবে। আওয়ামী লীগের ওপর হামলা-মামলা চলবে বেপরোয়াভাবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ‘মানুষ’ বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। কী প্রক্রিয়ায় মানুষ বানাবেন, তা কিন্তু পরিষ্কার করেননি। তবে সেটা যে খুব সহজ প্রক্রিয়া হবে না, তা বুঝতে কারও কষ্ট হচ্ছে না।

কোনও কোনও জায়গায় বিএনপির পক্ষ থেকে এমনও বলা হচ্ছে, ‘‘আওয়ামী লীগ আমাদের যেভাবে জ্বালিয়েছে, আমরা তাদের তারচেয়ে আরও বেশি জ্বালাব, তাদের ‘ভাতে মারবো, পানিতে মারব’, ঘর থেকে বের হতে দেব না।’’ আওয়ামী লীগ ছাড়াও দেশের উদারপন্থী মানুষের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি অনিরাপদ হয়ে উঠবে। উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পাবে। সংখ্যালঘুদের ওপর যে ধারায় আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছে, তা আরও বাড়বে বৈ কমবে না। কাজেই যারা আওয়ামী লীগ করেন না, কিন্তু দেশের মঙ্গল ও অগ্রযাত্রা কামনা করেন, তাদেরও আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়ানো উচিত। অবশ্য এর আগে আওয়ামী লীগকেই এগিয়ে আসতে হবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে। আওয়ামী লীগকে তাদের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করতে আন্তরিক হতে হবে। অহমিকা ত্যাগ করতে হবে, অন্যের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। কেবল আনুগত্য চাইলে হবে না, নিজেদেরও বিনয় দেখাতে হবে।

সময় না থাকায় ভদ্রলোকের সঙ্গে আলোচনা আর এগিয়ে নিতে পারিনি। তবে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তার সঙ্গে আমার দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ কম থাকায় তার বক্তব্য পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করলাম।

পাদটীকা: দেশের বেশিরভাগ মানুষ যখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, তখন লেখক-গবেষক-শিক্ষাবিদ মোরশেদ শফিউল হাসান তার ফেসবুকে একটি ভিন্ন মাত্রার স্ট্যাটাস দিয়েছেন। নির্বাচনে দলীয় সমর্থকদের বাইরে দল-নিরপেক্ষ যে বিশাল জনগোষ্ঠী, প্রকৃতপক্ষে ভোটের ফলাফল নির্ধারণে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তাদের বিষয়টি আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবি না। তারা অসংগঠিত কিন্তু নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। তাদের কাছে পৌঁছে তাদের যদি নিজেদের দিকে টানতে পারে আওয়ামী লীগ তাহলে তাদের দুশ্চিন্তা কিছুটা দূর হতে পারে।

আমার ভালো লেগেছে বলে মোরশেদ শফিউল হাসানের লেখাটুকু। তিনি লিখেছেন, সাইলেন্ট মেজরিটি বলে একটা পার্টি আছে। এমনিতে যার কথা কেউ মনে রাখে না। নির্বাচন কমিশনে তার নিবন্ধন নেই। দলটির কোনও নেতাও নেই। কিন্তু পাঁচ বছর পর পর দলটির অস্তিত্ব টের পাইয়ে ছাড়ে। আর কখনও কখনও তা ভীষণভাবেই।

লেখক: কলামিস্ট, বাংলা ট্রিবিউন

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin