অবৈধ আয়ে যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়ার আয়েশি জীবন

যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ গ্রেফতারের পর উঠে আসছে তার অবৈধ পথে আয়েশি জীবনযাপনের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। অবৈধ অর্থ পাচার, জাল টাকা সরবরাহ, মাদক কারবার ও অনৈতিক কাজে জড়িত পাপিয়া। সুন্দরী নারীদের দিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে অনৈতিক ব্যবসা করে আসছিলেন তিনি। ইন্টারনেটে স্কট সার্ভিস খুলে খদ্দেরদের কাছে তাদের চাহিদামতো সুন্দরী তরুণী পাঠাতেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তিনি শিক্ষিত সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করতেন। একপর্যায়ে তাদেরকে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের শয্যাসঙ্গী হতে বাধ্য করতেন পাপিয়া। নানা অনিয়মের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন পাপিয়া।

গতকাল হোটেল ওয়েস্টিনে পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরীর নামে বুকিংকৃত বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট রুমে এবং ফার্মগেটের ২৮ নম্বর ইন্দিরা রোডের রওশন’স ডমিনো রিলিভো নামে বিলাসবহুল ভবনে তাদের দু’টি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে বিদেশী পিস্তল, দু’টি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও পাঁচ বোতল বিদেশী মদ ও নগদ ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি চেক ও কিছু বিদেশী মুদ্রাসহ ১০টি ব্যাংকের ভিসা ও এটিএম কার্ড জব্দ করেছে র্যাব। গতকাল বিকেলে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল।

এর আগে গত শনিবার গোপনে দেশত্যাগের সময় নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সেক্রেটারি শামিমা নূর পাপিয়াকে তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতার অন্য তিনজন হলেনÑ পাপিয়ার স্বামী ও তার অবৈধ আয়ের হিসাবরক্ষক মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন, পাপিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী শেখ তায়্যিবা ও সাব্বির খন্দকার। এ সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, দুই লাখ ১২ হাজার ২৭০টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ জাল নোট, ৩১০ ভারতীয় রুপি, ৪২০ শ্রীলঙ্কান মুদ্রা, ১১ হাজার ৯১ মার্কিন ডলার ও সাতটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। র্যাব জানায়, যুবলীগ নেত্রী পাপিয়া পিউ নামেই বেশি পরিচিত। তারা প্রকাশ্য আয়ের উৎস গাড়ি বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা। তবে এর আড়ালে জাল মুদ্রা সরবরাহ, বিদেশে অর্থপাচার এবং অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, সুনির্দিষ্ট পেশায় না থাকলেও অল্প সময়রে মধ্যে বিপুল সম্পত্তি ও অর্থ বিত্তের মালিক বনে গেছেন পাপিয়া। ফার্মগেটের ২৮ ইন্দিরা রোডে তাদের দু’টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নরসিংদী শহরে দু’টি ফ্ল্যাট, ব্যক্তিগত গাড়ি ও নরসিংদীর বাগদীতে দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্লট আছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও তেজগাঁও এফডিসি গেট সংলগ্ন এলাকায় অংশীদারিতে তাদের ‘কার একচেঞ্জ নামে গাড়ির শোরুমে প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে এবং নরসিংদী জেলায় ‘কেএমসি কার ওয়াস এট অটো সলিউশনস নামে প্রতিষ্ঠানে ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে বলে র্যাবের কাছে স্বীকার করেছেন পাপিয়া ও তার স্বামী। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের নামে-বেনামে অনেক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে বলেও জানা যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতরা অধিকাংশ সময় রাজধানীর বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করেন। গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা বিভিন্ন মেয়াদে ৫৯ দিন হোটেল ওয়েস্টিনের কয়েকটি বিলাসবহুল রুমে অবস্থান করেন। যার আনুষঙ্গিক খরচসহ মোট ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৮.৩১ টাকা নগদ পরিশোধ করেন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রকৃত উৎস র্যাবকে জানাতে পারেননি তারা।

জানা গেছে, পাপিয়ার স্বামী সুমন চৌধুরী বেশির ভাগ সময় থাইল্যান্ডে অবস্থান করলেও গত থার্টিফার্স্ট নাইটে রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ছিলেন। ওই রাতে তার কক্ষেও চার-পাঁচজন সুন্দরী নারী ছিল বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। পাপিয়ার সব কর্মকাণ্ডের অন্যতম অংশীদার তার স্বামী সুমন। একসময় নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন সুমন। পরে ছিলেন নরসিংদীর মরহুম পৌরমেয়র লোকমানের বডিগার্ড।

র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফি উল্লাহ বুলবুল জানান, তার বার্ষিক আয় ১৯ লাখ টাকা হলেও পাপিয়া গত তিন মাসে শুধু একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করেছেন। এ ছাড়া তার নামে একটি হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট সব সময় বুকড থাকত। ওই হোটেলেই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল সাতটি মেয়ে। জানা গেছে, হোটেলটির বারে পাপিয়া প্রতিদিন বিল দিতেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

র্যাব জানায়, পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী নরসিংদীতে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক কারবার, চাঁদাবাজি, চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স প্রদান, গ্যাসলাইন সংযোগ ইত্যাদির নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তারা পুলিশের এসআই পদে ও রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে চাকরি দেয়ার নামে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাসসংযোগ দেয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা, একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স করে দেয়ার কথা বলে ২৯ লাখ টাকাসহ ঢাকা ও নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন বলে জানিয়েছে র্যাব। শুধু তাই নয়; ওই এলাকায় ‘কিউ অ্যান্ড সি নামে একটি ক্যাডার বাহিনী আছে তাদের। যাদের মাধ্যমে তারা নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, মাসোহারা আদায়, অস্ত্র ও মাদক কারবারসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য সব প্রকার অন্যায় কাজের সাথে জড়িত বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

র্যাব জানায়, পাপিয়া দম্পতির আয়ের অরেকটি উৎস হচ্ছে নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। তারা ঢাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করে কম বয়সী মেয়েদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করে। যাদের অধিকাংশইকে নরসিংদী এলাকা হতে চাকরি দেয়ার কথা বলে এবং বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয়েছে। এসব অনৈতিক কাজে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাদের বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো।

গ্রেফতার মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, দেশে স্ত্রীর ব্যবসায় সহযোগিতার পাশাপাশি থাইল্যান্ডে তার বারের ব্যবসা আছে। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে অবৈধ অস্ত্র, মাদক কারবার ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বিচারাধীন। তিনি স্ত্রীর মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় নারীদের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন। নরসিংদীর ‘কেএমসি কার ওয়াশ অ্যাট অটো সলিউশনস নামে প্রতিষ্ঠানটির আড়ালে চলে মাদক কারবার। জেলা শহরের বাইরে গেলে ক্যাডার বাহিনী তাকে বিশাল গাড়িবহরের মাধ্যমে মহড়া দিয়ে থাকে।
পাপিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী শেখ তায়্যিবা ও সাব্বির খন্দকার জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তারা সব সময় পাপিয়ার সাথে থাকতেন এবং তার ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। পাশাপাশি তার সব অবৈধ ব্যবসা, অর্থ পাচার ও রাজস্ব ফাঁকি দিতে সহযোগিতা করতেন।

যুব মহিলা লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার পাপিয়া
দেশী-বিদেশী মুদ্রা এবং নগদ টাকাসহ র্যাবের হাতে আটক নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নুর পাপিয়াকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে যুব মহিলা লীগ। গতকাল রোববার যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা অপু উকিল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নুর পাপিয়াকে গঠনতন্ত্রের ২২ (ক) উপধারা অনুযায়ী দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হলো। এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে।’

উল্লেখ্য, শনিবার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নুর পাপিয়াসহ চারজনকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা। এ সময় তাদের কাছ থেকে জাল টাকা, নগদ টাকাসহ দেশী-বিদেশী মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন ও নানা অসামাজিক কার্যকলাপের তথ্য বেরিয়ে আসে।

সূত্র: নয়া দিগন্ত

Check Also

জাতীয় সরকার নিয়ে হঠাৎ আলোচনা কেন?

প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Share
Pin